পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/২৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

232 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বিতীয় খন্ড হুলিয়া জারি করা হয় এবং তাঁহাদের আত্মগোপনে বাধ্য করিয়া তাঁহাদের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। সেই সামরিক সন্ত্রাসের সময়ে ন্যাপ কর্মী হাসান নাসিরকে লাহোর দূর্গে প্রাণ দিতে হয়। বহু কৰ্মীকে সরকারের “আইন” ভঙ্গ করার অপরাধে চাবুক মারা হয়। তখন বাড়ী-ঘর পরিষ্কার’ না রাখার জন্য শহরে ও গ্রামে বহু নিরপরাধ নাগরিককে পুলিশের হাতে অপমান সহ্য করিতে হইয়াছে। অনেককে জরিমানা দিতে হইয়াছে। জামার আস্তিন গুটাইয়া রাস্তায় চলার ‘অপরাধে’ বহু যুবককে আমলা পুলিশের হাতে লাঞ্ছনা ভোগ করিতে হইয়াছে। রাস্তার ডাইনে না চলিয়া হঠাৎ চিরাচরিত অভ্যাস অনুসারে বামে চলিতে গিয়া বহু নিরীহ পথচারীকে পুলিশের ব্যাটনের গুতা খাইতে হইয়াছে। সামরিক সন্ত্রাসের সেই সময়ে গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসন দাবী করিবার জন্য সাবেক বেলুচিস্তানে শত শত কর্মীকে বন্দী শিবিরে আটক করিয়া তাঁহাদের উপর নাৎসীসুলভ অত্যাচার চালানো হইয়াছে, ঐ অঞ্চলের জনগণের উপর আকাশ হইতে বোমা ফেলা হইয়াছে, সাবেক সীমান্ত প্রদেশের শত শত নেতা ও কর্মীকে বেত্রদন্ড দেওয়া হইয়াছে, তাঁহাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হইয়াছে এবং ঢাকা নগরীর রাস্তায় জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর বেপরোয়া লাঠি ও কাঁদুনে গ্যাস চালান হইয়াছে। জনাব আইয়ুব খাঁ আজ ভোটের জন্য গণতন্ত্রের যত কথাই বলুন, বহু দেশপ্রেমিকের পারিবারিক জীবনের ধ্বংস, বহু দেশপ্রেমিক কর্মী ও রাজবন্দীর পরিবারবর্গেও উপবাস, বহু কর্মীর পিঠে বেত্ৰাঘাতের চিহ্ন, হাসান নাসিরের মায়ের চোখের পানি প্রভৃতি জনাব আইয়ুব খাঁ'র সামরিক শাসনের সীমাহীন বর্বরতার জীবন্ত সাক্ষ্য বহন করিতেছে। সে সময়কার বর্বরতার সব কাহিনী লিখিতে গেলে মহাভারত রচিত হইয়া যাইবে। সুদীর্ঘ সাড়ে তিন বৎসর কাল ধরিয়া পাকিস্তানের জনগণ ঐ বর্বরতার অধীনে নিস্পেষিত হইয়াছেন। যদি আরও অধিককাল ঐ সামরিক শাসন রাখা সম্ভব হইত, তাহা হইলে জনাব আইয়ুব খাঁ তাহাও করিতেন। কিন্তু সামরিক জুলুমের বিরুদ্ধে দেশের জনগণ যেভাবে বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছিলেন, এবং বিদেশে, এমনকি বর্তমান শাসকবৃন্দের পীঠস্থান খোদ আমেরিকাতেও ইহার যে সমালোচনা হইতেছিল, তাহা উপেক্ষা করিয়া তখন সামরিক শাসন বেশিদিন চালু রাখা সম্ভব ছিল না। তাই, বাধ্য হইয়া জনাব আইয়ুব খাঁ ১৯৬২ সনে এক তথাকথিত শাসনতন্ত্র’ জারি করেন। ১৯৫৬ সনের শাসনতন্ত্রে জনগণকে ভোটাধিকার ও প্রত্যক্ষ নির্বাচন পার্লামেন্টারী শাসন, মৌলিক অধিকারসমূহের স্বীকৃতি ইত্যাদি কতকগুলি অধিকার দেওয়া হইয়াছিল। কিন্তু, জনাব আইয়ুব খাঁ’র শাসনতন্ত্রে জনগণের সেই ভোটাধিকার কাড়িয়া নেওয়া হইয়াছে। আইন সভাগুলির কার্যতঃ কোন অধিকার নাই। পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতির স্বায়ত্বশাসন অস্বীকৃতি হইয়াছে। এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা স্থাপন করিয়া দেশ শাসনের সমস্ত ভার দেওয়া হইয়াছে প্রেসিডেন্টের হাতে। ইহার গালভরা নাম দেওয়া হইয়াছে প্রেসিডেন্সিয়াল শাসন। প্রকৃতপক্ষে এই শাসনতন্ত্রের আড়ালে স্বৈরাচারী একনায়কত্ব কায়েম রহিয়াছে। তাছাড়া দল গঠনের উপর নানা প্রকার বিধিনিষেধ জারি হইয়াছে এবং বিভিন্নভাবে সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা হইতেছে। এখনও বহু দেশপ্রেমিক কর্মীকে প্রায়ই গ্রেপ্তার করা হইতেছে, এখনও অনেক কর্মী ও নেতার উপর হুলিয়া বুলিয়া আছে, এখনও জনগণের শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর পুলিশের লাঠি ও কাঁদুনে গ্যাস চালান হইতেছে এবং শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণ ধর্মঘট ভাঙ্গিবার জন্য গুন্ডা লেলাইয়া দিয়া বহু শ্রমিককে হতাহত করা হইতেছে। বস্ততঃ জনাব আইয়ুব খাঁ’র শাসনতন্ত্রের জামানতেও গণতন্ত্রকে গলাটিপিয়া হত্যা করা হইতেছে। তীব্র দমননীতির এই পরিবেশে এবং জনাব আইয়ুব খাঁ’র একনায়কত্বমূলক শাসনতন্ত্রের অধীনে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইতেছে তাহা এই গণবিরোধী সরকারের গণতন্ত্রের চিহ্ন বলিয়া গৃহীত হইতেও পারে না। আজ মিস