পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৭৯

সীতাকুণ্ড পাহাড় শ্রেণীর একটি বিচ্ছিন্ন ছোট পাহাড়ের ওপর গড়ে উঠেছে উদালিয়া চা বাগান। সৈন্যদের এখানে ছোট ছোট দলে ভাগ করে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ, খাবারের ব্যবস্থা এবং অন্যান্য কাজের ভার দেয়া হলো। এ্যাকশন গ্রুপকেও সদা প্রস্তুত রাখা হলো, যাতে তারা স্বল্পকালীন সময়ে শত্রুর মোকাবিলায় দ্রুত রওয়ানা হতে পারে। প্রয়োজনবোধে বিকল্প ঘাঁটি স্থাপনের স্থানটিও দেখে রাখা হয়। রক্ষাব্যূহ নির্মাণের কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হলে এই স্থানের দায়িত্ব লেফটেন্যাণ্ট এজাজের ওপর ন্যস্ত করে আমি কালুরঘাটের দিকে অগ্রসর হই।

 কালুরঘাটের প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে অধিকাংশই ছিলো ইপিআর সৈনিক। প্রাথমিক পর্যায়েই আমি যখন চট্টগ্রাম শহরে পাকসেনাদের সংগে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলাম। তখনই আমার সংগে যোগ দেয়ার জন্য চট্টগ্রামের সীমান্ত ফাড়িগুলো থেকে আগত ইপিআর সৈনিকদের অগ্রযাত্রা মেজর জিয়া থামিয়ে দেন। ইপি আর সৈনিকদের তিনি কালুরঘাটে রেখে দিয়েছিলেন। ৮ বেঙ্গল রেজিমেণ্ট এবং ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টারের কিছু সৈন্যকেও এখানে রেখে দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে কালুরঘাটে তখন ৬টি কোম্পানী ছিলো যার সৈন্য শক্তি ছিলো প্রায় এক হাজার।

 আমি যখন চট্টগ্রাম শহর নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নতুন লোকবল ও অস্ত্রবলের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করছিলাম তখন আমারই নির্দেশে আগত ইপি-আর সেনাদের কালুরঘাটে আটকে রাখা হয়। আমাদের সৈন্যদের কালুরঘাটে না থামিয়ে আমার সঙ্গে শহরের যুদ্ধে যোগ দিতে দেয়া হলে আমরা সাফল্যের সাথে নৌ-বাহিনীর সদর দফতর, বিমান বন্দর এবং ক্যাণ্টনমেণ্ট দখল করতে পারতাম। এর ফলে পাকিস্তানীরা আর নতুন সৈন্য আনতে পারত না এবং আমরাও সেখানে তাদেরকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিতে পারতাম। সে ক্ষেত্রে আমাদের যুদ্ধের ইতিহাস হতো সম্পূর্ণ ভিন্নতর।

 কি কারণে জানিনা, কালুরঘাট যুদ্ধ হয়েছিলো দুই সপ্তাহ পরে এবং এই দুই সপ্তাহ পর্যন্ত আমাদের এখানকার সৈন্যরা প্রায় কোন কাজেই লাগেনি। আমাদের তরুন অফিসাররা দুর্জয় মনবল এবং অদম্য সাহসের সংগে এখানে লড়াই করলেও সৈন্যরা কিন্তু যোগ্য সিনিয়র অফিসারের অভাব তীব্রভাবে অনুভব করছিলো। অবশ্য আমাদের সিনিয়র অফিসারদের সংখ্যাও তখন খুব বেশী ছিল না। এদের মধ্যে আবার মেজর শওকত কক্সবাজার চলে গিয়েছিলেন। ভূল খবরের ভিত্তিতেই এটা হয়েছিল। তারপর তিনি নিজেই কক্সবাজার ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে কালুরঘাটে আমাদের সৈন্যদের সাথে যোগ দেন।

 এখানে অমাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র তেমন ছিলো না। ৩০৩ রাইফেল ছাড়া আর ছিল কয়েকটি হালকা মেশিনগান এবং দুটি ৩” মর্টার। ইপি-আর মর্টার জেসিও দুটি মর্টার দিয়েই অবিশ্বাস্য কাজ করেছিলেন। মাত্র কয়েক রাউণ্ড মর্টার শেল দিয়েই তিনি শত্রু সৈন্যদের একাধিক জায়গায় ব্যস্ত রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি একাই দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে বিভিন্ন জায়গা থেকে মর্টার দাগতে থাকলে আমাদের মর্টারের সংখ্যা ঠিক কত পাকিস্তানীরা তা অনুমান করতে ব্যার্থ হয়। আমাদের প্রতিরোধের দুর্জয়তায় শত্রুরা বারবারই পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং পরিশেষে প্রায় দুসপ্তাহ পরে ১১ই এপ্রিল কালুরঘাটের যুদ্ধ চুড়ান্ত রুপ নেয়। কালুরঘাট সংঘর্ষে আমরা কেবল সৈনিকই হারাইনাই দুজন অফিসারও সেই সংকটকালে আহত হয়েছিল। ক্যাপ্টেন হারুন গুরুতর অবস্থায় বার্মায় আশ্রয় নিলেন, আর লেফটেন্যাণ্ট শমসের মবিন গুরুতর আহত অবস্থায় পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী হলেন।

 কালুরঘাট অবস্থান পরিদর্শনের পর আমি আবার রামগড় হয়ে ঘুরে কুমিরার দিকে অগ্রসর হই। কুমিরার সৈন্যদের জন্য আরো কিছু অস্ত্রশস্ত্র লাভের উদ্দেশ্যে রামগড়ে আমাকে কিছু সময় অপেক্ষা করতে হয়। রামগড়ে মেজর জিয়ার সঙ্গে আবার দেখা হলে তাকে আমি কালুরঘাট অবস্থানের আসারতার কথা বলি। তারপর কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে সোজা কুমিরার পথে রওনা হই। কুমিরায় তখনো আমাদের সৈন্যরা

শত্রুর সাথে মরণপণ লড়ে যাচ্ছিল।