পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৮৬

নিয়ে আসা হলো। শিবিরের জন্য যে হাসপাতালের ব্যাবস্থা করেছিলাম। যুদ্ধে আহতদের সেখানে আনা হয়। এরপর যুদ্ধ থেকে একটু অবকাশ পেলেই নতুনভাবে আমাদের বাহিনী সংগঠনের কাজ পুরোদমে শুরু হয়।

 মুজিব নগরে গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তখন অন্যান্য দেশের স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করছিলেন। কাজটি ছিলো খুবই দুঃসাধ্য। বাংলাদেশ বাহিনী একটা উল্লেখযোগ্য পরিমান এলাকায় তাদের দখল প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে কেউ আমাদের সরকারকে স্বীকৃতি দেবে না। যুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় বাংলাদেশের যে কোন একটি অঞ্চলে যতদুর সম্ভব সৈন্যদের জড়ো করে সেই এলাকা প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা যেত। সময় নষ্ট না করে সেই সময়ই এই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু দেখা গেছে কর্তৃপক্ষ সকল ফ্রণ্টেই যুদ্ধ করতে আগ্রহী এবং যুদ্ধ করে জয়ী হতেও চাইছিলেন। আমাদের সৈন্যসংখ্যা এবং তাদের পরিমানের প্রেক্ষিতে রণকৌশলগত দিক থেকে এ ব্যবস্থা ছিলো অবাস্তব। সব জায়গায় যুদ্ধ করার দরুন সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে আমাদের সেনাদের বিচ্ছিন্ন এবং স্থানীয়ভাবে লড়ে যেতে হয় এবং এই লড়ে যাওয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিলো লক্ষ্যহীন। তাই একটির পর একটি এলাকা আমাদের হাতছাড়া হয়ে যেতে থাকে।

 ৩০শে এপ্রিল মহালছড়ির সৈন্যরা রামগড় এসে পৌঁছে। এখান থেকে সকালে ছোট ছোট দলে হরিনা শিবিরের দিকে অগ্রসর হয়। ওদের আসার আগে কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে রামগড় ছেড়ে যেতে প্রস্তুত থাকার আদশ দিয়েছিলেন। এই আদেশে বোঝা গিয়েছিলো, হাই কম্যাণ্ড আমাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটাতে অসমর্থ। তখন সাহায্য ব্যতিরেকে মাত্র তিনদিনের বেশী যুদ্ধ করার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। কিন্তু অবাক কাণ্ড ৩০শে এপ্রিল রাতেই আরেকটি নতুন আদেশ পেলাম। বাংলাদেশ সরকারের জন্য রামগড় রক্ষা কর। ইতিমধ্যে চিকনছড়া থেকে আমরা সৈন্য সরিয়ে এনেছি। হরিনায় আমাদের নিরাপদ পশ্চাদপসরণের জন্য রামগড়ের বাইরে কিছু সৈন্য রেখেছি। যাতে শত্রুর অগ্রাভিযান কিছু সময়ের জন্য তারা বিলম্বিত করতে পারে। শত্রুবাহিনী রামগড়ের মাত্র কয়েক মাইলের মধ্যে এসে পড়েছে। আমাদের সৈন্যদের অর্ধেক তখন হরিণার রাস্তায়।

 অবশ্য সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্দেশ পাওয়ার পর রামগড় প্রতিরক্ষার জন্য উপস্থিত যাদেরকে পেলাম সবাইকে জড়ো করা হলো। পাকিস্তানী সৈন্য যাতে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে না পড়ে তা প্রতিহত করার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি দলও সাবরুমে চলে এল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই পদক্ষেপে কিছুটা ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিলো। গুজব রটেছিলো যে, রামগড় প্রতিরক্ষায় ভারতীয় সৈন্যরাও অংশ নিতে পারে। কিন্তু সে রকম কিছুই ঘটেনি।

 ১লা মে থেকে শত্রুরা রামগড়ের আশপাশের এলাকার ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। একটি দল মূল সড়ক ধরে অগ্রসর হচ্ছিলো। অন্য একটি দল রামগড়ের পূর্ব-দক্ষিণে পাহাড়ের দিকে এগোতে থাকে। এই পাহাড় এবং রামগড়ের মধ্যে কিছুটা জায়গা একেবারে খোলা এবং সমতল। ১লা মে দিবাগত রাতে এই পাহাড়ে গোপনে শত্রুসমাবেশ ঘটেছিলো।

 ২রা মে সকালে পাকিস্তানীরা মরিয়া হয়ে রামগড়ের ওপর আক্রমণ শুরু করে। কামানের প্রচণ্ড গোলার ছত্রছায়ায় তারা সড়কপথে আমাদের প্রথম প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেঙ্গে দেয়। শেলের আঘাতে আমাদের বাংকারগুলো ভেঙ্গে পড়তে থাকে। এদিকে সেই পাহাড় এবং রামগড়ের মধ্যবর্তী স্থানটিতে ধোঁয়ার জাল সৃষ্টি করা হয়। এবং ধোঁয়ার আড়ালে শত্রুদের দ্বিতীয় দলটি রামগড়ের মধ্যভাগের দিকে অগ্রসর হয়। সন্ধ্যার ঘণ্টাখানেক আগে শত্রুরা শহরটির মধ্যাঞ্চলের ওপর চুড়ান্ত আক্রমণ চালায়। এতে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। এরপর এক ঘণ্টারও বেশী সময় আমাদের সৈন্যরা শত্রুর ওপর গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখে এবং পরিশেষে গুলি ফুরিয়ে গেলে তারা অন্ধকারের আড়ালে পশ্চাদপসরন করে।