পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৮৮

 ওদিকে কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে আগত পাকসেনাদের নিকট ফেনী শহরের পতন ঘটে। ১১ই মে'র মধ্যে তারা শুভপুর সেতুর কাছে এসে পড়ে।

 পাকিস্তানীদের এই কলামে শত্রুদের আনুমানিক দুটি ব্যাটালিয়ন ছিলো। পক্ষান্তরে সেতুর কাছে একশ- এরও কমসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা তখন চুড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তত। পরের দিন শুরু হয় যুদ্ধ।

 ১২ই মে সকাল থেকে করেরহাটের কমাণ্ডগুলো আমাদের ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। অপরদিকে নদীর পাড়ে শত্রু ট্যাংকগুলোকে ও দেখা যায়। পাকিস্তানীরা আমাদের অবস্থানের উত্তর এবং পশ্চিম দিকে ধূম্রজালের সৃষ্টি করে। সকাল ১১টায় পশ্চিম দিকের সেই ধোয়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে দুটি কোম্পানী প্রথম হামলা শুরু করে। কিন্তু বেশকিছু পরিমান ক্ষতি স্বীকার করে তাদেরকে পিছু হটতে হয়। তারপর কিছু সময় সব চুপচাপ। বেলা ৩টার দিকে প্রচণ্ড গোলাবর্ষনের সঙ্গে সঙ্গে তারা আবার হামলা শুরু হয়। দুটি শত্রু ব্যাটালিয়নকেই হামলায় অংশ নিতে দেখা যায়। দিনের বাকী সময়টুকু আমাদের সেনাদেরকেও প্রচণ্ডতম গোলাবর্ষণের মোকাবিলা করতে হয়। প্রায় অর্ধেক মুক্তিযোদ্ধাই তখন শেলের আঘাতে আহত। সরাসরি আঘাতে বাংকারগুলো ধসে পড়লে অনেকেরই জীবন্ত সমাধি ঘটে। আমরা হতাহতদের সড়াতে পর্যন্ত পারছিলাম না। নতুন সৈন্যও যোগ হচ্ছিলো না। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা খাদ্য কিংবা পানির মুখ দেখেনি। বেলা ৫টার দিকে কামানের গোলাবর্ষণ বন্ধ হয়। শত্রুরা তখন আমাদের অবস্থান থেকে আনুমানিক ৩০০ গজ দূরে। শুধু একটি মেশিনগান এবং দুটি লাইট মেশিনগান দিয়ে আমরা এদের মোকাবিলা করছিলাম। ট্যাংকের আঘাতে অস্ত্রগুলো ধ্বংশ হওয়ার পুর্বক্ষণ পর্যন্ত সেগুলো সমানে শত্রু নিধন করে চলে। এরপর আমাদের সৈন্যরা শুধু ৩০৩ রাইফেল দিয়ে গুলি চালাতে থাকে। অচিরেই হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানীদের তুলনায় সংখ্যায় আমরা ছিলাম খুবই কম। আমাদের যেসব সেনা ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থানে ছিলো তারা শেষ পর্যন্ত পশ্চাদপসরণ করতে পেরেছিলো। এদের অধিকাংশই ছিলো গুরুতর আহত, কিন্তু তবু তাদের মনোবল ভেঙে পড়েনি।

 তখন সন্ধ্যা হয় হয়। শুভপুর সেতুর অদুরে ভারতের শ্রীনগর সীমান্ত ফাড়ি। এখান থেকে একটি কাচা রাস্তা পাহাড়ের ভেতর দিয়ে আগরতলা অভিমুখী প্রধান সড়কে গিয়ে মিশেছে। এই সন্ধ্যায় রাস্তাটিতে অন্য কোন লোক ছিল না। শুধু রনাঙ্গন ফেরত কিছু লোক নিঃশব্দে হেটে চলছিলো। এদের মধ্যে কেউ হাটছিলো লাঠিতে ভর দিয়ে, কয়েকজনকে আবার সহযোদ্ধা ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো। পথে আমাদের একজন অফিসারের সাথে তাদের দেখা হলে জনৈক মুক্তিযোদ্ধা তার বাম হাত তুলে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানায়। তার ঝুলন্ত ডান হাত থেকে রক্ত ঝরছিলো। শেলের বিচ্ছুরিত টুকরোয় এটি প্রায় দু ভাগ হয়ে গিয়েছিলো। শুধু কুঁকড়ে যাচ্ছিল। তবু সে মুখে একটু হাসির ভাব ফুটিয়ে অফিসারকে “জয় বাংলা” বলে শুভেচ্ছা জানায়। তারপর সে অন্যদের সাথে সামনে অন্ধকারের মধ্যে এগিয়ে যায়।

চট্টগ্রামের প্রতিরোধ যুদ্ধঃ

সাক্ষাৎকার : লেঃ জেনারেল (অবঃ) মীর শওকত আলী বীর উত্তম

 প্রঃ কখন কিভাবে আপনি একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন?

 উঃ ১৯৭১ সালের জানুয়ারী মাসে কোয়েটা স্টাফ কলেজ থেকে আমাকে চট্টগ্রামের ষোলশহরে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্টে পোষ্টিং দিয়ে পাঠানো হয়। মার্চ ৭১ এর প্রথম ভাগে আমি ছুটিতে ছিলাম। ১৫ই মার্চ এর দিকে যখন অসহযোগ আন্দোলন খুব জোরদার হচ্ছিল এবং ইতিপূর্বে ৭ই মার্চ ৭১ এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

[১]


  1. ১৯৭১ সালের মার্চে মেজর পদে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি শামসুল হুদা চৌধুরী রচিত 'একাত্তরের রণাঙ্গন' গ্রন্থ থেকে সংকলিত।