পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৯৪

 ২৬শে এপ্রিল ক্যাপ্টেন কাদের, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান ও লেঃ মাহফুজকে কিছুটা পিছিয়ে যেতে বললাম। ঐ তারিখেই ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানকে নানিয়ারচর বাজারে বড় পাহাড়ের ওপর ডিফেন্স নিতে বলেছিলাম। কারণ ঐ পথই পাক সেনাদের অগ্রসর হওয়ার সম্ভাব্য এলাকা ছিল। লেঃ মাহফুজকে ডিফেন্সে রাখলাম রিজার্ভে পাল্টা আক্রমণের জন্য এবং প্রয়োজনে ক্যাপ্টেন জামানকে সাহায্যের জন্য। ক্যাপ্টেন কাদেরকে পাঠালাম সড়ক পথে পাকবাহিণীর গতিপথ রুদ্ধ করার জন্য।

 ২৫শে এপ্রিল ভোরবেলা হাবিলদার তাহের সিপাহী বারী এবং করপোরাল করিমের সংগে ৮/১০ জন লোক দিয়ে রেকি পেট্রোলে পাঠালাম। এই দলটি ভুলবশতঃ মিজোদের আড্ডায় ঢুকে পড়েছিল। সৌভাগ্যবশত মিজোরা তখন একটি হাতি কেটে খাওয়াতে ব্যাস্ত ছিল। রেকি পার্টি পালিয়ে আসতে সমর্থ হয়। আমাদের দলটি পরে হেডকোয়ার্টার মহালছড়িতে পৌছে। ঐ তারিখ বেলা ১২-৩০ মিঃ সময়ে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীর অবস্থানের ওপর মিজোর আক্রমন চালিয়েছিল।ফলে উভয় পক্ষে সংঘর্ষ বেধে যায়। আক্রমনের চাপ বাড়তে থাকে মিজোদের পক্ষ থেকে। মিজোর ছিল সংখ্যায় অনেক। এই অবস্থায় আমি লেঃ মাহফুজকে প্রায় ১০জন সৈন্য নিয়ে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের সাহায্যে পাঠিয়েছিলাম। লেঃ মাহফুজ ওখানে পৌঁছেই ডিফেন্স নিয়ে লক্ষস্থলে আক্রমন চালাতে থাকে। কিন্তু ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান তার সার্থীদের গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় ভিন্ন ভিন্ন পথে পিছু হটে আসেন। আধ ঘণ্টা গুলি বিনিময়ে লেঃ মাহফুজ ১৫০জন মিজোকে হত্যা করেছিলো। কিন্তু অপর পক্ষে সব বাধাকে অগ্রাহ্য করে অসংখ্য মিজো সমুদ্রের ঢেউয়ের মত সমনের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। লেঃ মাহফুজকে মিজোরা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল। খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন কাদের এবং ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান লেঃ মাহফুজকে উদ্ধার করে আনার জন্য অগ্রসর হলেন। আমরা তখন হেডকোয়ার্টারের চারপাশে ডিফেন্স পাকা করছিলাম। এমনি পরিস্থিতিতে ২৭শে এপ্রিল অপরাহ্ন ৩টায় পাকবাহিনীর ১১ এবং পাঞ্জাবের ২টি কোম্পানী সহযোগে প্রায় এগার শত মিজো ব্যাপকভাবে আমাদের ওপর আক্রমন চালায়। পাকবাহিনী ৬টি মর্টার দিয়ে আক্রমন চালাতে থাকে। চারদিকে শুধু আগুন আর আগুন। আমি করার জণ্য আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। পাক সেনারা মিজোদের নিয়ে ক্রমাগত অগ্রসর হতে থাকে আধুনিক মারনাস্ত্র নিয়ে। অথচ আক্রমন প্রতিহত করার জন্য উপযোগী কোনও ভারী মর্টার আমার কাছে ছিল না। মাত্র থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও সামান্য হালকা মেশিনগান দিয়ে আক্রমন চালালাম। ক্যাপ্টেন কাদের তার এলাকাতে যুদ্ধ করতে করতে শত্রর গুলিতে শহীদ হলেন। বৃষ্টির মতো গুলির মধ্যে সওকত ফারুক ও সিপাহী ড্রাইভার রামগড় রেখে বাকী সৈন্যরা আমার কাছে চলে আসেন। আমরা তখন এমনি এক অবস্থায় ছিলাম। যখন আমার সমস্ত বাহিনী নিয়ে ঐ পরিস্থিতিতে পিছু হটা সম্ভব ছিল না। তাই সন্ধ্যা পর্যন্ত আক্রমন চালিয়ে যেতে হয়েছিল। ঐ তারিখে রাতের আধারে মহালছড়ি ছেড়ে সমস্ত সৈন্য নিয়ে আমরা খাগড়াছড়ি নামক স্থানে এসে পৌঁছলাম এবং ডিফেন্স নিলাম।

 ২৮শে এপ্রিল খাগড়াছড়ি থেকে আমি মেজর জিয়ার সাথে আয়ারলেসের মাধ্যমে যোগাযোগ করে আমাদের অবস্থার কথা বর্ননা করলাম। ঐদিন পাকবাহিনীর একটি দল আমাদের অবস্থান দেখে গুইমারা হয়ে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আমি আমার বাহিনী নিয়ে গুইমারাতে ডিফেন্স নিলাম। আমাদের তখন শক্তি ছিল প্রায় ৪৫০জন। আমি মানিকছড়ির রাজার সংগে দেখা করলাম। রাজা আমাদের সাথে যোগ দিলেন। তিনি খবরাখবর দিলেন। সমগ্র মগ উপজাতি আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। চাকমা উপজাতিদেরও হয়ত আমাদের সাহায্যে পেতাম। কিন্তু রাজা ত্রিবিদ রায়ের বিরোধিতার জন্য তারা আমাদের বিপক্ষে চলে যায়। মিজোরা বেশ কিছু আগেই আমাদের শক্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের ন’মাস মগ উপজাতি আমাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করেছে।