পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৯৭

দেওয়ার জন্য একজন সিনিয়র বাঙ্গালী অফিসারের দরকার। তুমিই একমাত্র বাঙ্গালী অফিসার কুমিল্লাতে যাকে আমি এ ব্যাপারে বিশ্বাস করতে পারি।

 আমি বুঝতে পারলাম যেতে আমাকে হবেই। উপায় যখন আর নেই তখন যতটুকু তাদের কাছে আদায় করে নেয়া যায় সেটুকুই আমার পক্ষে মঙ্গল। আমি ব্রিগেডিয়ার শফিকে বললাম, যে কাজের ভার আমাকে দিচ্ছেন শুধু একটা কোম্পানী দিয়ে তা হবে না। কোম্পানীর চেয়ে বেশী সৈন্য আমাকে দেয়া হোক। আর হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য একটা শক্তিশালী ওয়ারলেস দেওয়া হোক। এছাড়া যেহেতু আমি অনেক দুরে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছি। সেহেতু আমার ট্রপস এর জন্য স্বয়ংক্রিয় ভারী এবং হালকা অস্ত্রশস্ত্র এবং মর্টার ইত্যাদি এবং যথেষ্ট পরিমান গোলাবারুদ দেয়ার অনুমতি দেয়া হোক। ব্রিগেডিয়ার শফি প্রথমে বললেন, তোমাকে যে কাজের জন্য পাঠান হচ্ছে, তাতে এসব ভারী অস্ত্রশস্ত্রের দরকার হবে না। আমি উত্তরে বললাম যে, আপনি যে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থার কথা চিত্রিত করেছেন তাতে আমার সামরিক জ্ঞান অনুসারে এই সমস্ত ভারী অস্ত্রশস্ত্রের দরকার হবে বিশেষ করে যেখানে হেড কোয়ার্টার থেকে তাড়াতাড়ি সাহায্য পাবার আশা কম। আমার বক্তব্যে ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি কনভিনসড হলেন এবং কর্নেল খিজির হায়াতকে নির্দেশ দিলেন আমার যা প্রয়োজন তা যেন আমাকে দিয়ে দেওয়া হয়। আমরা বিগ্রেডিয়ার শফির কাছ থেকে ইউনিটে ফিরে এলাম। এসেই ব্যাটালিয়নের এডজুট্যাণ্ট ক্যাপ্টেন গফফারকে (এখন মেজর) ডেকে নির্দেশ দিয়ে দিলাম সমস্ত ব্যাটালিয়ন থেকে বেছে বেছে ২৫০ জনের মত সৈন্যকে আলফা কোম্পানীতে একত্রিত করার জন্য।

 গফারকে বলে দিলাম যে, ব্যাটালিয়নের ভারী অস্ত্রশস্ত্র যতো আছে সব নিয়ে নাও। গোলাবারুদ এমন ভাবে নেবে যাতে একমাস যুদ্ধ করা যায়। আমাদের ২৬টা গাড়ী ব্রিগেড থেকে দেওয়া হয়েছিল। সব বোঝাই করতে এবং অস্ত্রশস্ত্র ও সৈনিকদের তৈরী করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। এই সময় আমি একটা অস্বাভাবিক ঘটনা দেখতে পাই। যতোক্ষণ পর্যন্ত আমি এবং আমাদের লোকজন প্রস্তুত হচ্ছিলাম ততক্ষণ পর্যন্ত খিজির হায়াত এবং অন্যান্য ব্রিগেড স্টাফ এর অফিসাররা বসে লক্ষ্য করতে থাকলেন।

 আমি ২৪শে মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় যাওয়ার জন্য তৈরী হই। ব্যাটালিয়নে যে সমস্ত বাঙ্গালী অফিসার থেকে গেল তারা সবাই আমার যাবার পূর্বে মেসে এসে দেখা করে গেল। এদের মধ্যে সিনিয়র অফিসার ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিন (বর্তমানে মেজর) তাকে আমি এই উপদেশ দিলাম যে আমি চলে যাচ্ছি, এতে ঘাবড়াবার কিছু নাই। এখন তুমিই সিনিয়র। যদি কোনো অঘটন ঘটে তাহলে এই ৪র্থ বেঙ্গল এর বাকী ট্রপস এর নিরাপত্তার পুরা বন্দবস্ত করবে এবং যদি প্রয়োজন হয় যুদ্ধ করে ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে বেরিয়ে আসবে এবং আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আমি আমার কনভয় নিয়ে শমসেরনগরের পথে রওনা হলাম। রাত প্রায় ২টা আরাইটার সময় বি-বাড়িয়া শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছলাম। সেখানে রাস্তায় অনেক ব্যারিকেড। এই প্রতিবন্ধকতার জন্য আমাদের এগোতে অসুবিধা হচ্ছিল। এই ব্যারিকেড ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে শহরের দিকে এগোচ্ছিলাম। শহরের কিনারে যে পুল আছে (নিয়াজ পার্কের কাছে) সেখানে বি-বাড়িয়ার ছাত্র জনতা আমাদের বাধা দেয়। হাজার হাজার লোক এবং ছাত্র রাস্তায় শুয়ে পড়ে এবং বলে যেতে দেওয়া হবে না। আমি সেখানকার নেতৃস্থানীয় লোকদের সাথে কথা বলতে চাইলাম। ওখানেই আওয়ামী লীগের তদানীন্তন এমসিএ সাচ্চু মিয়া এবং অন্য কয়েকজন আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রনেতারা আমাকে জানান যে, পূর্ব বাংলার অনেক যায়গায় পাকসেনারা আবার গুলি চালিয়েছে এবং মিলিটারী চলাচল কেন্দ্রীয় নির্দেশে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। তারা আরও বলেন আপনাদের বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সৈনিকদের ইচ্ছাকৃতভাবে কুমিল্লা থেকে দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছে এবং আমরা আপনাদের যেতে দেব না। এই ভাবে কয়েকঘণ্টা কথাবার্তা হয়। ইতিমধ্যে মেজর শাফায়াত জামিল (বর্তমানে লেঃ কর্নেল), যিনি ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের আর একটা কোম্পানীসহ বি-বাড়িয়াতে অবস্থান করছিলেন, তিনিও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তিনিও তাদের বুঝাতে চেষ্টা করলেন যাতে ব্যারিকেড এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু তাতেও তারা আমাদের অনুরোধ রাখতে রাজী হয় না। তারপর তাদের নিয়ে মেজর শাফায়াত জামিলের ক্যাম্পে যাই। সেখানে আবার কথাবার্তা চলে এবং তাদের