পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৯৮

আমি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিই যে বেঙ্গল রেজিমেণ্ট বাংলাদেশেরই রেজিমেণ্ট, যখন দরকার পড়বে বাঙ্গালী জাতির জন্য পিছিয়ে থাকবে না। এমতাবস্থায় আমাদের বাধা দেওয়া ঠিক হবে না। অবশেষে সকাল সাড়ে পাঁচটায় সব নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা আমাদেরকে আর বাধা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আমরা শমসেরগনের পথে আবার ২৫শে মার্চের সকালে রওনা দিলাম। যাওয়ার আগে মেজর শাফায়াত জামিলকে আলাদা ডেকে সতর্ক করে দিলাম এবং আমার সঙ্গে অয়ারলেস মারফত যোগাযোগ রাখার নির্দেশ দিয়ে গেলাম। আমি সকাল দশটা এগারটার সময় শ্রীমঙ্গলে পৌঁছি। সেখান থেকে শমসেরনগর যাবার রাস্তা আমার জানা ছিল না। ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার থেকে আমাকে বলে দেওয়া হয়েছিল যে, শমসেরনগর যেতে হলে মৌলভীবাজার হয়ে যেতে হবে। শ্রীমঙ্গলে কনভয় দার করিয়ে স্থানীয় কিছু ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করি শমসেরনগরে যাওয়ার রাস্তা সম্ভন্ধে এবং জানতে পারি মৌলভী বাজার হয়ে যাওয়া যায় অথবা আর একটা রাস্তা আছে সোজা শ্রীমঙ্গল হয়ে জঙ্গল এবং পাহাড়ের মধ্য দিয়ে এই রাস্তা অপেক্ষাকৃত কম দুরত্বের আমি এই সোজা জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে শমসেরনগরের পথে রওনা হলাম। যে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সে রাস্তা পরিত্যাগ করে পাহাড়ের পথ দিয়ে রওনা হলাম এই রাস্তা খুব খারাপ ছিল তাই অতি কষ্টে দুপুর ২টার সময় শমসেরনগরে গিয়ে পৌঁছি। সেখানে যেয়ে ডাকবাংলোতে আমি আমার ছাউনি স্থাপন করি।

 দুপুরে খেয়ে আমি এবং লে. মাহবুব শমসেরনগরের চারদিকে ঘুরে দেখে আসি দেখি পরিস্থিতি স্বাভাবিক। আর কিছু পেট্রোল পার্টি চতুর্দিকে পাঠিয়ে দিই। স্থানীয় ব্যাক্তিদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে যানতে পারি কোন অঘটন সেখানে ঘটেনি। ইপিআর এর যে দুটো কোম্পাণীর কথা আমাকে বলা হয়েছিলো। তাদের কোন পাত্তা নেই। ইপিআরএর একজন সুবেদার এবং আরো কয়েকজন সিপাই শমসেরনগর এয়ারপোর্টে অবস্থান করছিল। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সঠিক কোন উত্তর পাইনি। শমসের নগরের টি গার্ডেন গুলো ঘুরে জানতে পারলাম। সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ম্যানেজার এবং অফিসাররা ঢাকায় চলে এসেছে। নক্সালপন্থী বা অনুপ্রবেশকারীদের কোন চিহ্ন আমি খুজে পেলাম না। ২৫শে মার্চের রাতটা এভাবে খবরাখবর নিয়ে এবং পেট্রোলিং করে কেটে গেল। সমস্ত ব্যাপারটা আমার কাছে ঘোড়ালো মনে হলো। আমার মনে জাগল আমাকে এখানে কৌশল করে পাঠানো হয়েছে। এবং যা কিছু তারা বলেছিল, তা সবই মিথ্যা। আমি সমস্ত সকাল অয়ারলেসের মাধ্যমে হেড কোয়ার্টারে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি কিন্তু কোন যোগাযোগ হল না। এই ভাবে দুপুর পর্যন্ত চলে যায়। আমি এবং লে. মাহবুব ডাকবাংলোর বারান্দায় বসেছিলাম। হঠাৎ আমাদের এসে খবর দেয় এক পাঞ্জাবী অফিসার এবং বেশ কয়েকজন সৈন্য শমসেরনগরের বাজারে এসেছে এবং সেখানে কারফিউ জারি করে স্থানীয় জনসাধারনের উপর অত্যাচার করছে। সেই দলটি আমাদের ক্যাম্পের সম্মুখে দিয়ে মৌলভীবাজার যাচ্ছিল। আমাদের সেণ্ট্রিকে সেই দলটির অফিসারকে ডাকার জন্য পাঠাই। এরা যখন সামনে দিয়ে যাচ্ছিল তখন সেণ্ট্রি তাদের আমাদের ক্যাম্পে আসার অনুরোধ জানায়। অফিসারটি ক্যাম্পের ভিতরে আসে এবং আমার সেখানে উপস্থিতি সম্বন্ধে আশ্চর্যবোধ করে। এমন ভাব দেখায় যে আমর এখানে আছি এটা সে জানত না। কথাবার্তায় আমি জানতে পারি যে ৩১ পাঞ্চাব রেজিমেণ্টের বেশ কিছু সৈন্য সিলেট থেকে মৌলভীবাজার এসে দুই দিন আগে ক্যাম্প করেছে। অফিসারের হাবভাব এবং কথাবার্তা আমাকে সন্দিহান করে তোলে। যতক্ষন সে ডাকবাংলোয় বসেছিলো ততক্ষন সে স্টেনগানটি কোথাও না রেখে নিজের হাতে রাখে। এতে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। এদের আগমন সম্বন্ধেও আমাকে অবহিত করা হয়নি। এটাও অত্যান্ত অস্বাভাবিক কিছুক্ষণ পরে অফিসারটি তার দলবল নিয়ে চলে যায়। এবং যাওয়ার আগে আমাদেরকের পাঞ্জাব রেজিমেণ্টে ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। আমি যাওয়ার আশ্বাস দিয়ে অফিসারটিকে বিদায় করলাম।

 সেই দিনই বিকেলে স্থানীয় জনসাধারণের মুখে আমি জানতে পাই ঢাকাতে কিছু একটা ভয়ংকর অঘটন ঘটেছে। কিন্তু কেউ সঠিক কিছু বলতে পারে না। আস্তে আস্তে লোকমুখে আরও শুনতে পাই যে, ঢাকায় পাক সেনাবাহিনীর হাজার হাজার লোক গুলি করে মেরে ফেলেছে এবং মারছে। বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গাতেও পাক বাহিনী সেই রূপ নৃশংস অত্যাচার এবং হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার লোক ঢাকা ছেড়ে জান