পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১০৪

প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করে। মেজর সফিউল্লাহ তাঁর বাহিনী নিয়ে মাধবপুরের দিকে চলে যায়। পাক বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে এক ব্যাটালিয়ন শক্তি নিয়ে আসে এবং আখাউড়া আক্রমণ করে কিন্তু অনেক ক্ষয়ক্ষতি এবং হতাহত স্বীকার করে তারা পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়।

 আমি এই সময়ে কুমিল্লার দক্ষিণে যে দলটি ছিল অর্থাৎ ৪ বেঙ্গলের বি কোম্পানী তাদেরকে লে. মাহবুব এবং লে. দিদারুলের (বর্তমানে উভয়েই ক্যাপ্টেন) নেতৃত্বে আরও কিছু সৈন্য পাঠিয়ে জোরদার করি।

 কুমিল্লা থেকে এপ্রিল মাসের ১৫/১৬ তারিখে পাক বাহিনীর বিরাট এক কনভয় প্রায় ৩০টি গাড়ীতে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে লাকসামের দিকে যাচ্ছিল। লে. মাহাবুরের নেতৃত্বে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের বি কোম্পানীর সৈন্যরা শত্রুসেনারা এই দলটিকে দুপুর বারোটায় জাঙ্গালিয়ার নিকটে এ্যামবুশ করে। এই ব্যামবুশে শত্রুসেনাদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। সংঘর্ষ প্রায় পাঁচ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। পাকসেনারা গড়ী থেকে নেমে এ্যামবুশ পার্টিকে 'আক্রমণ করার চেষ্ট করে কিন্তু আমাদের সৈন্যদের সাহসিকতা এবং কৌশলের কাছে পর্যুদস্ত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এই সংঘর্ষে লে. মাহবুব এবং লে. দিদার যথেস্ট কৌশলের এবং যুদ্ধনিপুণতার পরিচয় দিয়েছিল। লে. মাহবুব তাঁর সৈন্যদের নিয়ে রাস্তার পূর্ব পাশে এ্যামবুশ করে ওঁৎ পেতে বসেছিল। যখন শত্রুদের কনভয় তার এ্যামবুশ-এর মাঝে পড়ে যায়, তখন সে তাদের উপর তার লোকজন দিয়ে গুলি ছুড়তে থাকে। এতে কটা গাড়ী রাস্তা থেকে একসিডেণ্ট করে পড়ে যায়। বাকী গাড়ীগুলো থেকে পাকসেনরা লাফালাফি করে নীচে নামার চেষ্ট করে। এতেও তাদের যথেষ্ট হতাহত হয়। যে সব পাকসেনা গাড়ী থেকে ভালভাবে নামতে পারে তারা রাস্তার উপরে (পশ্চিম দিকে) গিয়ে একত্রি হয় এবং লে. মাহবুরের উপর আক্রমণের প্রস্ততি নেয়। এদিকে লে, দিদারুল আলম রাস্তার পশ্চিম পার্শ্বে বেঙ্গল রেজিমেণ্ট-এর সৈন্য নিয়ে তৈরী ছিল। সে পাকিস্তানীদের উপর আকস্মাৎ প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এই ভাবে দুই দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে এবং নিজেদের এত হতাহত দেখে শত্রুসেনাদের মনোবল একবারেই ভেঙ্গে যায়। মৃতদেহ ফেলে রেখে তারা কুমিল্লার দিকে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধের ফলে লে. মাহবুব এবং লে. দিদারুল আলমের সম্মিলিত দলটি ২টি মেশিনগান ৬টি হালকা মেশিনগান এবং অজস্র রাইফেল আহত এবং নিহত শত্রু সেনাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। যে বিধ্বস্ত গাড়ীগুলো শত্রুরা ফেলে গিয়েছিল তা থেকে কয়েক হাজার এ্যামুনিশন উদ্ধার করা হয়। এর তিন দিন পরে স্থানীয় জনসাধারাণ আরও ২টি হালকা মেশিনগান, কয়েকটা রাইফেল এবং বেশ কিছু গোলাবারুদ যা শত্রুসেনা পালিয়ে যাবার সময় ধানক্ষেতে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল আমাদেরকে পৌঁছে দেয়। এই একশনের ফলে আমার এ্যামুনেশনের প্রয়োজনীয়তা সাময়িকভাবে মিটেছিল এবং পাক বাহিনী বেশ কিছুদিন কুমিল্লার দক্ষিণে অগ্রসর হবার সাহস দেখায়নি।

 এই সময় আখাউড়াতে পাক বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিক থেকে আবার আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে তাদের ২৫ জনের মত হতাহত হয় এবং পাক বাহিনী আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পশ্চাদপসরণ করে। এপ্রিল মাসের শেষে পাক বাহিনী কুমিল্লা থেকে উত্তর দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাস্তায় অগ্রসর হয়ে ১২ নং ফ্রাণ্টিয়ার ফোর্স নিয়ে সাইদাবাদ দখল করে নেয়। পরে পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে তারা নিয়ামতবাদ, গঙ্গাসাগর দখল কের নেয়। আমি তখন কুমিল্লার বিবিরবাজার এলাকাতে যেখানে পাকবাহিনী প্রতিদিন আক্রমণ চালাচ্ছিল সেখানে যুদ্ধ পরিচলান করছিলাম। গঙ্গাসাগার, নিয়ামতাবাদ শত্রুকবলিত শুনতে পেয়ে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনকে নির্দেশ দিই ৪র্থ বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানী নিয়ে কসবার উত্তরে চণ্ডিমুরা উঁচু পাহাড়ে প্রতিরক্ষব্যূহ শক্ত করতে এবং সেই রাতেই কুমিল্লার দক্ষিণ হতে ৪র্থ বেঙ্গলের আলফা কোম্পানীকে উঠিয়ে আমার সঙ্গে নিয়ে গঙ্গাসাগরের নিকটে দুটি কোম্পানীকেই একত্রি করি। সন্ধ্যায় যখন আমি চণ্ডিমুরার নিকটে পৌঁছি তখনই শত্রুদের অবস্থান সম্বন্ধে মোটামুটি একটা বিবরণ ইপিআরদের কাছ থেকে অবগত হই এবং সেই রাত্রেই গঙ্গাসাগর এবং নিয়ামতাবাদে শত্রুদের উপর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিই। ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন, ক্যাপ্টেন গাফ্ফার এবং একজন সুবেদারের নেতৃত্বে আলফা, চার্লি এবং ডেল্টা কোম্পানী নিয়ে ভোর পাঁচটায় শত্রুদের উপর আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেই। এই আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল যে ক্যাপ্টেন গাফফার এবং ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন পূর্ব দিক