পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১১৪

গৌরলা প্রভৃতি জায়গা হয়ে শত্রু অবস্থানটি প্রায় তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছিল এবং প্রতিদিন আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। অবস্থা এরূপ সঙ্গীন হয়ে গিয়েছিল যে পাকসেনাদের পক্ষে তাদের বাংকার থেকে মাথা তোলারও সুযোগ ছিল না। গুলি এবং মর্টারের গোলার সাহায্যে আমাদের সৈনিকরা তাদের সে অবস্থানে থাকাকে সম্পূর্ণ বিপদজ্জনক করে তুলেছিল। এছাড়া কুটি এবং শালদানদীর রাস্তায় আমাদের এ্যামবুশ পার্টি ২৪ ঘণ্টা এ্যামবুশ পেতে থাকত। এর ফলে রশদ এবং অস্ত্র সরবরাহ করা তাদের পক্ষে মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা রেলওয়ে লাইন ব্যবহারের বার বার চেষ্টা করেও বিফল হয়েছে। এরপর শালদানদী দিয়ে রসদ সরবরাহ করার চেষ্টা করে। সেখানেও তারা আমাদের দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এমতাবস্থায় তাদের মনোবল সত্যিই ভেঙ্গে গিয়েছিল।

 জুন মাসের ১ তারিখে আমাদের চাপের মুখে টিকতে না পেরে তারা মন্দভাগ এবং শালদানদীর অবস্থানগুলি পরিত্যাগ করে নয়নপুর রেলওয়ে স্টেশনের নিকট তাদের নতুন ঘাঁটি স্থাপন করে। সম্মুখসমরে শালদানদী থেকে শত্রুসেনাকে জুন মাসের প্রথম দিকে পর্যদস্ত করে পিছু হটিয়ে দেওয়া আমাদের সৈনিকদের জন্য ছিল একটা বিরাট সাফল্য ও কৃতিত্ব। এতে আমার সেক্টরের সব সৈনিকদের মনোবল পুনরুদ্ধার হয়। মার্চ মাস এবং মে মাসের প্রথম দিকে যখন পাক বাহিনী অতর্কিতে বিপুল সৈন্য, কামান, বিমান বাহিনীর সহায়তায় আমাদের উপর আক্রমন চালায় তখন আমাদের সৈনিকরা অতি সাহসিকতা ও বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে পাক সেনাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি করে কিন্তু অবশেষে বেশিরভাগ সময়ে পাক বাহিনীর বিপুল শক্তি ও সরঞ্জামের সামনে বাধ্য হয়ে পিছু হটতে হয় এবং সর্বক্ষেত্রেই আমরা প্রতিরক্ষা অবস্থানে থেকে যুদ্ধ করেছি এবং পাক বাহিনী বার বার আমদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। শালদানদী এবং মন্দভাগে প্রথম এক মাস পর আমরা পাকবাহিনীর উপর প্রতি আক্রমন চালিয়ে তাদের শক্তিশালী অবস্থান থেকে বিতাড়িত করি। শত্রু সেনা চলে যাবার পর ক্যাপ্টেন গাফ্ফারকে মন্দভাগে প্রধান অবস্থান গড়ে তোলার এবং শালদানদীতে তাঁর অগ্রবর্তী ঘাঁটি করার নির্দেশ দিই।

 যখন আমি যুদ্ধ চালাচ্ছিলাম এবং যুদ্ধ আস্তে আস্তে যখন তীব্রতর হচ্ছিল, তখন আমার সেনাদলে আহত এবং নিহতের সংখ্যাও বেড়ে চলছিল। সে সময়ে আমার সৈনিক এবং গণবাহিনীর জন্য চিকিৎসার বন্দোবস্ত ছিল না, শুধু আমার সঙ্গে সেনাবাহিনীর ১ জন ডাক্তার ক্যাপ্টেন আখতার ছিলেন। অফিসারের সল্পতায় তাঁকেও আমি একটা কোম্পানীর কমাণ্ডার বানিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়োগ করেছিলাম এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন আখতার ডাক্তার হয়েও একজন যোদ্ধা হিসেবে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। আমার আহতের সংখ্যা যখন বেশ বেড়ে যায় এবং অনেক সময় দ্রুত চিকিৎসার অভাবে অনেক সৈনিক বা গণবাহিনীর ছেলেরা রক্তক্ষয় হয়ে মারা যেতে থাকে তখন আমি বুঝতে পারলাম যে আমার সেক্টরেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য ক্যাপ্টেন আখতারকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ডেকে পাঠাই এবং অতি সত্বর আমার হেড কোয়ার্টারের নিকট একটি চিকিৎসালয় স্থাপন করার নির্দেশ দিই। ঢাকা থেকে কিছু সংখ্যক ছেলে মেয়ে আমার সেক্টরে এসে আশ্রয় নেয়। এদের মধ্যে দুই একজন চিকিৎসা শিক্ষানবিসও ছিল। তারাও আমাকে ১ টি হাসপাতাল গড়ার জন্য অনুরোধ জানায়। এসব ছেলেমেয়ে নিয়ে ক্যাপ্টেন আখতার কয়েকটি তাঁবুতে মতিনগরে আমার হেড কোয়ার্টারের নিকট মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রথম বাংলাদেশ হাসপাতালের ভিত্তি স্থাপন করেন। একটা সুন্দর বাগানের ভিতর উঁচু এবং শান্ত পরিবেশে এ হাসপাতালটি অবস্থিত ছিল। প্রথমে হাসপাতালের ব্যবহারের জন্য আমাদের কাছে ঔষুধপত্র বা অস্ত্রোপাচারের সরঞ্জাম কিছুই ছিলনা। কিন্তু তবুও আমাদের এই নবীন দলটি ক্যাপ্টেন আকতারের নেতৃত্বে সমস্ত বাধাবিপত্তি সত্তেও ধীরে ধীরে হাসপাতালটি গড়ে তুলতে থাকে। এদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য বেগম সুফিয়া কামালের দুই মেয়ে টুলু এবং লুলু মেডিকেল ছাত্রী ডালিয়া, আসমা রেশমা, ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, সবিতা, শামসুদ্দিন প্রমুখ। এসব ছেলেমেয়েদের দল নিজেদের সুখ ও আরাম ত্যাগ করে দিন রাত কঠোর পরিশ্রম করে যুদ্ধ ক্ষেত্রে আহত সৈনিকদের এবং গণবাহিনীর ছেলেদের সেবাশুশ্রূষা ও চিকিৎসা করে যাচ্ছিল। এরা রেডক্রস ও বন্ধু রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনেক কষ্টে ওষুধপত্র যোগাড় করত। মাঝে মাঝে আমি যতটুকু টাকা-পয়সা সেক্টর ফাণ্ড থেকে দিতে পারতাম তা দিয়ে ওষুধপত্র যোগাড় করত। জুন মাসের দিকে লণ্ডন থেকে ডাঃ মবিন