পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১১৫

(প্রবাসী বাঙ্গালী) আমাদের এই হাসপাতালের কথা শুনে এখানে এসে যোগ দেন। এর কিছু দিন পর ডাঃ মবিনের আর এক বন্ধু ডাঃ কাফরুল্লাহ সংবাদ পেয়ে লণ্ডন থেকে এসে যোগ দেন। এরা দুজনেই লণ্ডনে এফআরসিএস পড়ছিলেন। দেশে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ শুনে তারাও এসে অংশ নেয়ার জন্য আগ্রহী ছিলেন। তারা তাদের লণ্ডনের সব সুখ ও আরাম ত্যাগ করে আমাদের এ হাসপাতালের নাম শুনে ছুটে এসেছিলেন মাতৃভূমিকে শত্রুদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য। তাদের সঙ্গে আমার বিস্তারিত আলাপ হয় এবং আমার এই হাসপাতালটি গড়ে তোলার জন্য একটি পরিকল্পনা নিই। ডাঃ মবিন ও ডাঃ জাফরুল্লাহ আমাকে আশ্বাস দেন লণ্ডনে অবস্থিত প্রবাসী বাঙালিরা তাদের মাতৃভূমির জন্য সব কিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছে এবং আমরা যদি বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের কাছে আহবান জানাই তবে এ হাসপাতালে সরঞ্জামের ব্যবস্থা তারা করতে পারবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমি ডাঃ মবিন ও ডাঃ জাফরুল্লাহকে বিস্তারিত সরঞ্জামের তালিকা বানানোর নির্দেশ দেই। আর সেই সঙ্গে ক্যাপ্টেন আখতারকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর একটু পিছে বিশ্রামগঞ্জে সুন্দর জায়গায় পাহাড়ের উপর অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণের জন্য পরিকল্পনা নিতে নির্দেশ দিই। আমার সঙ্গে এ ব্যাপারে আমাদের প্রধান সেনাপ্রতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীর (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল) সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়। তাকে আমি আমার সেনাদল ও ছেলেদের চিকিৎসার শোচনীয় অবস্থার কথা জানাই। তিনি আমাকে আমার হাসপাতাল তৈরীর পরিকল্পনায় উৎসাহ দেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ত্রিশ হাজার টাকা মঞ্জুর দেন। এক মাসের মধ্যে বাঁশ, কাঠ ও ছন দিয়ে আমরা বিশ্রামগঞ্জে ২০০ বেডের হাসপাতাল তৈরী করে ফেলি। ডাঃ জাফরুল্লাহ লণ্ডনে চলে যান হাসপাতালের জন্য ওষুধপত্র ও অস্ত্রোপচারের সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করতে। আমাদের হাসপাতাল যখন তৈরি হচ্ছিল তখন আহতের সংখ্যাও দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল। ডাক্তারের যথেষ্ট অভাব ছিল। এছাড়াও ওষুধের অভাব ছিল আমাদের প্রকট। কিন্তু তবুও এসব অসুবিধার মধ্যেও আমাদের ছোট হাসপাতালটি আস্তে আস্তে পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠছিল। যদিও এগুলি বাঁশ এবং ছনের ঘর ছিল তবুও উৎসর্গিত ছেলেমেয়েদের প্রচেষ্টায় সমস্ত এলাকাটা শান্তিদায়ক হয়ে উঠেছিল। সকালে উঠেই সমস্ত হাসপাতালের বিভিন্ন কাঁচা ওয়ার্ডগুলি তারা নিজ হাতে লেপতো এবং পরিস্কার করতো। হাসপাতাল রোগীর কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে তাদের রান্নাবান্না, সেবাশুশ্রূষা সব কিছু এরাই করতো। এদের সঙ্গে আরো ২০ জনের মতো ছেলেমেয়ে এসে যোগ দেয়। কিছুদিন পর ডাঃ জাফরুল্লাহ ও ডাঃ মবিনের প্রচেষ্টায় এবং লণ্ডন প্রবাসী বাঙালি ডাক্তারদের সহায়তায় আমরা এ হাসপাতালটির জন্য অস্ত্রোপাচারের সরঞ্জামাদিসহ ওষুধপত্র পেয়ে যাই। ৯ মাসের যুদ্ধে এ হাসপাতালটি কয়েক হাজার আহতকে চিকিৎসা ও অস্ত্রোপাচার করতে সক্ষম হয়। এ হাসপাতালটির আর একটি অবদান ছিল যে এটি স্থাপনের পর আমার সেনাবাহিনীর ছেলেদের ও গণবাহিনীর মনোবল আরো বেড়ে যায়। তারা বুঝতে পারে যদি তারা যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হয় তবে চিকিৎসার অভাবে মারা যাবে না। যুদ্ধকালীন সময়ে প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী হাসপাতালটি পরিদর্শন করেন এবং এটাকে আরো উন্নত করার জন্য উৎসাহ দেন। সেপ্টেম্বর মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেণ্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ হাসপাতালটি পরিদর্শন করেন এবং এর ভূয়সী প্রশংসা করেন।

 ২৯ শে মে রাতে আমাদের একটা পেট্রোল পার্টি কুমিল্লার বাটপাড়ায় এ্যামবুশ পেতে বসে থাকে। শত্রুদের ২ টা গাড়ী রাত ২ টার সময় এ্যামবুশ এর ফাঁদে পড়ে। এ্যামবুশ পার্টি সাফল্যের সাথে ২ টি গাড়ী ধ্বংস করে দেয় এবং সেই সঙ্গে ৪ জনকে নিহত করে। শত্রুদের পিছনের গাড়ীটি ফাঁদে পড়ার আগেই পালিয়ে যায়। ২৯ শে মে রাত ৯ টায় ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে ২ টি সেকশন কসবার পশ্চিমে টি, আলীর বাড়িতে শত্রুদের অবস্থানের উপর অকস্মাৎ অণুপ্রবেশ করে এবং আক্রমণ চালায়। সঙ্গে সঙ্গে মর্টারের সাহায্যে আড়াইবাড়ী শত্রুঅবস্থানের উপর গোলা চালায়। এ আক্রমনে শত্রুদের ১ টা বাংকার ধবংস হয়ে যায় এবং তিনজন লোক নিহত ও ২ জন শত্রুসেনা আহত হয়। এরপর আমাদের সৈন্যরা আক্রমণ শেষ করে নিজ অবস্থানে চলে আসে।

 ৩১ মে রাত তিনটায় একটা প্লাটুন লে মাহবুবের নেতৃত্বে কুমিল্লার দক্ষিণে জহমোহনপুর নামক স্থানে শত্রু ঘাঁটির উপর অকস্মাৎ আক্রমণ চালায় এবং শত্রু সেনাদের ১২ জন হতাহত হয়। পাকসেনারা যখন কসবার