পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১১৯

পক্ষে যথেষ্ট সুবিধা হবে। যে করেই হোক ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিমকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি মোটেই স্বাভাবিক নয়। বরং বাংলাদেশের অধিকাংশ স্থানই পাক বাহিনীর আয়ত্তাধীনে নেই।

 এ পরিপ্রেক্ষিতে আমি গেরিলার একটি দলকে ঢাকা শহরে বিভিন্ন জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটানো এবং পাকিস্তানীদের নিহত করার জন্য পাঠিয়ে দিই। এই দলটি ৪ঠা জুন ঢাকায় গোপন পথে রওনা হয়ে যায় এবং পর দিন সকালে পৌছে যায়। এই দলেরই ২ জন ছেলে ৮ই জুন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় জিন্নাহ এভিনিউর কলেজ সু স্টোরের সামনে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। আর একটি গ্রেনেড ছোড়ে পুরানা পল্টনে সন্ধ্যা আটটায়। ঐ দিনই আর একটি ছোট দল ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্টের ভিতর একজন পাকিস্তানী অফিসারের বাড়ীর ভিতরে দুপুর দুটোর সময় গ্রেনেড ছোড়ে। এতে অফিসারের গাড়ীটির ক্ষতিসাধিত হয় এবং একজন লোক আহত হয়। পরের দিন সন্ধ্যায় মর্নিং নিউজ অফিসের ভিতর গ্রেনেড ছোড়া হয়। এতে কয়েকজন পাকিস্তানী দালাল নিহত হয়। ইতিমধ্যে দলটি খবরাখবর নেয় যে, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিম হোটেল ইণ্টারকণ্টিনেণ্টালে অবস্থান করছে। এ খবর পাবার পর ২ জন গেরিলা ৯ই জুন সন্ধ্যা ৮-১৫ মিনিটে হোটেল ইণ্টারকণ্টিনেণ্টালে প্রবেশ করে এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিম এ হোটেলে ফেরার প্রতিরক্ষায় থাকে। তারা যখন তাদের গাড়ীতে করে আসেন এবং গাড়ী নিচে রেখে হোটেলের ভিতরে প্রবেশ করেন সে সময় গেরিলা দলটি গাড়ী লক্ষ করে ৩টি গ্রেনেড ছোড়ে। এর ফলে গাড়িটি সম্পূর্ন রুপে ধ্বংস হয়ে যায় এবং নিকটবর্তী একজন পাঞ্জাবী সেনাও নিহত হয়।

 এ সমস্ত ঘটনাবলীতে বিশ্ব ব্যাংক কর্মকর্তাগণ অতি সহজেই বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হন। ইণ্টারকণ্টিনেণ্টালের বিস্ফোরণের তারা ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী। তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) বর্তমান অবস্থা স্বাভাবিক নয়। এই ঘটনার পর বিশ্ব ব্যাংক টিম দেশে ফিরে গিয়ে তাদের রিপোর্টে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্বন্ধে সঠিক ঘটনাবলী তুলে ধরেন। তারা তাদের রিপোর্টে পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য না দেওয়ার সুপারিশ করেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এটা ছিল পাকিস্তানের পক্ষে এক বিরাট পরাজয়।

 রাজাপুর রেলওয়ে স্টেশনের নিকট পাচড়া গ্রামে শত্রুদের একটি অবস্থান ছিল। এই অবস্থানটি শত্রুদের নয়নপুর এবং রাজাপুর রেলওয়ে স্টেশনের পিছন থেকে সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত হত। মতিনগর থেকে একটি রেইডিং পার্টিকে পাচড়া গ্রামে শত্রুঅবস্থানের উপর অনুপ্রবেশ করে আক্রমন করার নির্দেশ দেয়। ১৩ই জুন রাত নটার সময় এ দলটি গ্রামের গোপন পথে শত্রু অবস্থানের ভিতর অনুপ্রবেশ করে এবং অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ অতর্কিত আক্রমণে শত্রুদের মধ্যে সম্পূর্ন বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আমাদের দলটি বেশ কিছু পাকসেনাকে হতাহত করে শত্রু অবস্থান থেকে সরে পড়ে। কিন্তু এরপরেও শত্রুদের মধ্যে রাতের অন্ধকারে প্রায় ২ঘণ্টা গোলাগুলি চলতে থাকে। পাকসেনাদের অয়্যারলেস ম্যাসেজ আমাদের অয়ারলেসে ধরা পড়ে। এতে শোনা যায় পাকসেনারা তাদের ঊর্ধ্বতন হেড কোয়ার্টারকে জানাচ্ছে মুক্তিবাহিনী আমাদের উপর ভয়ংকর আক্রমন চালাচ্ছে। আমাদের নির্দেশ দিন আমরা এখন কি করব। এছাড়াও শত্রু অবস্থান থেকে বার বার শ্লোগান শোনা যায় পাকিস্তান জিন্দাবাদ, আজিজ ভাট্টি জিন্দাবাদ, ১৭তম পাঞ্জাব জিন্দাবাদ ইত্যাদি। গোলাগুলির প্রচণ্ড আওয়াজ তখনও চলতে থাকে। আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের দলটি সরে আসার পরও পাক বাহিনী নিজেদের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা গোলাগুলি করে বীরত্বের পরিচয় দিচ্ছে। এ সংঘর্ষে পাকসেনাদের ১১জন নিহত ও ১২জন আহত হয়। বেশ কিছুসংখ্যক সৈন্য তাদের নিজেদের গুলিতেই হতাহত হয়।

 পাকিস্তানীরা সীমান্তের নিকটবর্তী থানাগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ এবং মিলিশিয়া নিয়োগ করতে শুরু করে। এসব থানাগুলিতে তারা বাংকার তৈরী করে অবস্থানকে শক্তিশালী করতে তাকে। কুমিল্লার উত্তরে সবগুলো থানাকেই তারা এভাবে শক্তিশালী করে। আমি এসব থানাগুলোকে আক্রমণ করে পাকিস্তানীদের শাসনযন্ত্রকে অচল করে দেয়ার একটা পরিকল্পনা করি।