পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১২৩

প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও অন্যান্য বিস্তারিত খবর নিয়ে আসে। এ সংবাদ পেয়ে লেঃ মাহবুব ৩৩ জনের একটি কমাণ্ডো প্লাটুন ব্লাকসাইড ও মর্টারসহ রাত ১২টার সময় শত্রুঅবস্থানের নিকটে পৌঁছে যায়। তারা একটি ছোট দল পাঠিয়ে অবস্থানটির সর্বশেষ খবর নেয় এবং জানতে পারে পাকসেনারা অবস্থানটিতে বেশী সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়নি। রাত ১টায় আমাদের কমাণ্ডো প্লাটুনটি অতর্কিতে পাকসেনাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের ভিতর অনুপ্রবেশ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনাদের উপর হালকা অস্ত্রের সাহায্যে গুলি চালাতে থাকে। পাকসেনারা অনেকেই গুলিতে হতাহত হয়। তারা আমাদের কমাণ্ডো প্লাটুনের উপর পাল্টা আক্রমনের চেষ্টা করে, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়ে যায়।

 ১৮ই জুন রাত ৯টায় মিয়াবাজারের দক্ষিণে আমাদের আরেকটি প্লাটুন পাকসেনাদের ২টি বাংকারের উপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমনে ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনারা এরপর সমস্ত রাত অবিরাম মর্টারের গোলা ছুড়তে থাকে। আমাদের এই দলটি খিলা রেলওয়ে স্টেশনের নিকট কয়েকটি ট্যাঙ্কবিধ্বংসী মাইন রাস্তায় পুতে রাখে। পাক সেনাদের একটি জীপ রাতে ঐ রাস্তায় যাওয়ার পথে মাইনের উপর পড়ে যায় এবং সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয় এবং ৫জন পাকসেনাও নিহত হয়।

 জুন মাসেই পাকসেনারা কুমিল্লা শহরে শাসনকার্য পুনরায় স্বাভাবিক করার জন্য সমস্ত রকমের ব্যবস্থা নেয়। সরকারী অফিস ভালভাবে চলার জন্য তারা সরকারী কর্মচারীদের বাধ্য করে। শহরের দোকান ও যানবাহন চালু করার বন্দবস্ত করে। পাকিস্তানীদের এ প্রচেষ্টা ব্যার্থ করার জন্য ৪জন গেরিলার একটি দলকে ৬ই জুন কুমিল্লার উত্তর দিয়ে গোমতী পার করে কুমিল্লা শহরে পাঠান হয়। এ দলটি গ্রেনেড ও স্টেনগান সঙ্গে নিয়ে যায়। তিনদিন পর্যন্ত শহরের ভিতর একটি গুপ্ত অবস্থানে দলটি নিজেদের ঘাটি গড়ে। কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন জায়গায় পাকসেনাদের টহলদার দলগুলি সম্বন্ধে তারা বিস্তারিত খবরাখবর যোগাড় করে। ১০ই জুন সন্ধ্যায় কমার্স ব্যাঙ্ক, ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক, জজকোর্ট প্রভৃতি স্থানে পর পর পাকসেনাদের উপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এর ফলে একজন পাকসেনা নিহত ও ৫জন আহত হয়। ঐ দিনই ৭জন রেঞ্জারের একটি দলকে তারা আক্রমণ করে। এতে ২জন মিলিশিয়া নিহত হয় এবং তাদের একটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর কয়েকদিন পর ২১শে জুন সকালে একটি আর আর রাইফেল আমাদের সৈন্যরা কুমিল্লা শহরের নিকটে বয়ে নিয়ে যায় এবং কুমিল্লা বিমান বন্দরের ও শহরের উপকণ্ঠের উপর গোলাগুলি করে এবং পাকিস্তানীরা এতে পাগলের মত ছোটাছুটি করতে থাকে। এসব কার্যকলাপের ফলে কুমিল্লা শহর ও তার নিকটবর্তী এলাকার লোকেরা আবার তাদের সাহস ফিরে পায়। অনেকেই শহর থেকে বাইরে চলে যায়। এসব আক্রমণের ফলে পাকিস্তানীদের শাসন ব্যবস্থা চালু করার প্রচেষ্টা বহুলাংশে ব্যর্থ হয়।

 শালদা নদীতে পাকসেনারা জুন মাসে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করার চেষ্টা করছিল। পাকসেনাদের কার্যকলাপে বিঘ্ন সৃষ্টি করার জন্য এবং তাদেরকে ব্যস্ত রাখার জন্য মেজর সালেক ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানীর ১টি প্লাটুন মর্টারসহ শালদা নদীর পশ্চিম দিকে পাঠিয়ে দেয়। এই প্লাটুনটি রাত ৩টায় পাকসেনাদের অবস্থানটি ঘুরে পিছনে যেতে সক্ষম হয়। সকাল সাড়ে ৫টার সময় পূর্বনির্ধারিত স্থানে তারা নিজেদের ঘাটি স্থাপন করে। এরপর প্রত্যুষের সঙ্গে সঙ্গেই পিছন থেকে মেশিনগান ও অন্যান্য হালকা অস্ত্রশস্ত্র এবং মর্টারের সাহায্যে শত্রু অবস্থানের ওপর অতি নিকট থেকে হামলা চালায়। পাকসেনারা দিনের বেলায় তাদের অবস্থানের পিছনে এত নিকট থেকে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না এবং এর ফলে তাদের অন্ততঃপক্ষে ১জন জেসিওসহ ৩২জন হতাহত হয়। পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল রাতে শালদা নদীর অবস্থান হতে কসবাতে টহলের জন্য গিয়েছিল। এই সংবাদটি আমাদের লোকের জানাছিল না। পাকসেনাদের সঙ্গে আমাদের প্লাটুনটি যখন ভয়ংকর সংঘর্ষ করছিল, সে সময় পাকসেনাদের টহলদার দলটি কসবা থেকে ফেরার পথে আমাদের প্লাটুনটির পিছনে অবস্থান নিয়ে আমাদেরকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। আমাদের প্লাটুনটি সঙ্গে সঙ্গে অতিকষ্টে পাকসেনাদের ঘেরাও থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। আসার সময় আমাদের একজন লোক আহত হয়। পাকসেনারা এরপর শালদা নদী অবস্থান আরো শক্তিশালী করে তোলে।