পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১২৬

পাকসেনাদের একটা কোম্পানী, কসবায় টি, আলীর বাড়ী থেকে একটা কোম্পানী-এই দুই কোম্পানী দুদিক থেকে এসে কায়েমপুরের নিকট মিলিত হয়। তারপর মর্টার মেশিনগান এবং কামানের সাহায্যে আমাদের মন্দভাগ অবস্থানে আক্রমণ চালায়। প্রচণ্ড গোলার সহায়তায় পাকসেনাদের এই শক্তিশালী দলটি মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনে ৩০০ গজ পশ্চিমে জেলা বোর্ডে সড়কের নিকট পর্যন্ত পৌছতে সক্ষম হয়। আমাদের সৈনিকরাও তাদের বাঙ্কার থেকে মেশিনগান এবং হাল্কা মেশিনগানের গুলীতে পাকসেনাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করতে থাকে। দুঘণ্টা চেষ্টার পর পাকসেনারা যখন অগ্রসর হতে পারছিল না তখন আক্রমন বন্ধ করে দেয় এবং পিছু হটে চলে যায়। এ আক্রমনের সময় পাকসেনাদের ২৪জন হতাহত হয়। পাকসেনারা তাদের কায়েমপুরের অবস্থানও তুলে নিয়ে শালদানদীর মূল ঘাটিতে চলে যায়।

 ঢাকায় আমাদের গেরিলারা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। বিদ্যুৎ সরবরাহ যাতে স্বাভাবিকভাবে না চলে সেজন্য তারা ২৯শে জুন বিকেল পাচটায় সিদ্ধিরগঞ্জ এবং খিলগাও পাওয়ার লাইনের একটি পাইলন ধ্বংস করে দেয়। এই বিধ্বস্ত পাইলনটি অন্য দুটি পাইলনের তার নিয়ে ছিড়ে পড়ে যায়। এর ফলে কমলাপুর এবং তেঁজগাওয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ অনেকাংশে কমে যায়। বিস্ফোরণের ঠিক পরপরই পাকসেনাদের একটি হেলিকপ্টার তৎক্ষণাৎ উক্ত এলাকায় গেরিলাদের অনেক খোজাখুজি করে। আমাদের গেরিলারা নিরাপদে ফিরে আসে। আর একটি গেরিলা দল সিদ্ধিরগঞ্জের মাটির তলার পাওয়ার লাইন মাতুয়াইলে উড়িয়ে দেয়। পাকসেনারা নিকটবর্তী ঘাটি হতে জীপে করে এসে দলটিকে ধরার চেষ্টা করে এবং এদের উপর গোলাগুলী করে, কিন্তু গেরিলা গলটি নিরাপদে ফিরে আসে।

 স্থানীয় লোকমুখে আমরা সংবাদ পাই যে, পাকসেনাদের একটি জীপ ও টহলদার দল প্রায়ই সাইদাবাদ থেকে কর্নালবাজার পর্যন্ত আসে। এ সংবাদ পেয়ে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন খোলাপাড়ায় এবং তুলাইশমলে একটি করে প্লাটুনের সাহায্যে এ্যামবুশ লাগায়। ২৭শে জুন সন্ধ্যার সময় পাকসেনাদের টহলদার দল খোলাপাড়ায় আমাদের এ্যামবুশে পড়ে যায়। এতে পাকসেনাদের ৮জন লোক নিহত হয় এবং তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। এর পরদিন ২৮শে জুন সন্ধ্যা ৭টায় পাকসেনাদের একটি জীপ তুলাইশমলে আমাদের এ্যামবুশে পড়ে। এ্যামবুশ পার্টির গুলিতে জীপটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রাস্তা থেকে পড়ে যায়। জীপে পাঁচজন পাকসেনা ছিল, তারাও সঙ্গে সঙ্গে নিহত হয়। আমাদের পার্টি অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেয়।

 পাকসেনারা কুমিল্লা শহরের পূর্বে বিবিরবাজার এলাকায় যে ঘাটি গড়েছিল, আমরা প্রায়ই আক্রমণ করে তাদের ব্যতিব্যস্ত রাখতাম। লেঃ মাহবুব খবর পায় যে, পাকসেনারা সন্ধ্যার পর আর তাদের বাংকার থেকে বাইরে আসে না। রাতে যেসব পাহারাদার থাকে তারা বাংকারের মধ্যে বসে থাকে। এ সংবাদ পেয়ে লেঃ মাহবুব দুটি প্লাটুনকে ২৪শে জুন রাতে শত্রুদের বিবিরবাজার ঘাটির কয়েকটি বাংকার ধ্বংস করার নির্দেশ দিয়ে কুমিল্লার দক্ষিণ থেকে পাঠিয়ে দেয়। এ দলটি অরণ্যপুর হয়ে শত্রুদের বিবিরবাজার অবস্থানের পিছনে পৌছে এবং রাত তিনটায় অবস্থানের ভিতর অনুপ্রবেশ করে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। প্রথমেই তারা তাদের সামনের একটি বাংকারে গ্রেনেড ছোড়ে এবং সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। এরপর আরও ২/১টি বাংকার ধ্বংস করে তারা সকাল হবার আগেই শত্রু অবস্থান ত্যাগ করে। এই অতর্কিত আক্রমণে পাকসেনাদের ২১জন নিহত ও ৭জন আহত হয়।

 পাকসেনারা বিজয়পুরের যে রাস্তার সেতুটি আমাদের কমাণ্ডো পার্টি উড়িয়ে দিয়েছিল সেটি সাময়িকভাবে মেরামত করে ফেলে এবং সে রাস্তায় আবার তাদের চলাফেরা শুরু করে। লেঃ মাহবুব আবার একটি কমাণ্ডো প্লাটুন পাঠায় এবং এই প্লাটুনটি ২১শে জুন বিজয়পুর ব্রীজের নিকট এ্যামবুশ পেতে পাকসেনাদের অপেক্ষায় থাকে। রাত ২টার সময় পাকসেনাদের দুটি গাড়ী কুমিল্লা থেকে ঐ রাস্তায় আসে। গাড়ীগুলী যখন ব্রীজের উপর দিয়ে চলা শুরু করে ঠিক তখনই আমাদের পার্টি তাদের উপর গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ীগুলি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ব্রীজ থেকে নদীতে পড়ে যায়। এতে দুটি গাড়িই বিনষ্ট হয়ে যায় এবং ৮জন পাকসেনা নিহত হয়।