পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৩২

মতামত জানতে চাই। আমি তাঁকে বলি যে, আমরা তৈরি এবং তাঁকে তাড়াতাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কোম্পানী নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করি। আমার সাথে যখন খালেদ মোশাররফের কথোপকথন চলে তখন সাদেক নেওয়াজ, লেঃ আমজাদ সাইদ এবং খিজির হায়াত খান আমাকে খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিল। সেই জন্য খুব বেশী কথাবার্তা চালানো সম্ভব হয়নি এবং তিনিও সমশেরনগর থেকে বেশী কথা বলেননি। শুধু বলেছিলেন যে, তিনি রাতের অপেক্ষায় আছেন।

 তার পর থেকেই আমার জুনিয়র অফিসাররা তাড়াতাড়ি যেকোন সিদ্ধান্ত নেবার জন্য আমাকে পীড়াপীড়ি করছিল। আমি ব্যাটালিয়নের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন জুনিয়র অফিসারের মতামতের অপেক্ষায় ছিলাম। কেননা, সামান্য ভুল সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী না হলে সবকিছু পণ্ড হয়ে যাবে এবং নিজেদের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় হতাহত হবে। আমি অন্ততঃ একজন অফিসার এবং একজন জেসিওকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার জন্য সারারাত সময় দিই। সন্ধ্যার সময় আমি ইচ্ছাকৃতভাবে সৈনিকদের ক্যাম্পের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। আমাকে দেখা মাত্রই বেশ কয়েকজন সৈনিক যাদের মধ্যে কয়েকজন এনসিও ছিলেন, আমাকে ঘিরে ধরেন এবং বলেন যে, “স্যার দেশের মধ্যে যে কি হচ্ছে তা আপনারা আমাদের চেয়ে অনেক ভাল বোঝেন। আমরা অফিসারদের মুখর দিকে তাকিয়ে আছি। আপনাদের যেকোন নির্দেশ আমরা জীবন দিয়ে পালন করতে প্রস্তুত। আপনারা যদি বেশী দেরী করেন তবে হয়ত আমাদের কাউকে পাবেন না। আমরা আগামীকালের পরেই যে যার বাড়ির দিকে রওনা হব। কিন্তু সঙ্গে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাব। সৈন্যদের এই মনোবল ও সাহস দেখে আমি খুব গর্বিত ও আশান্বিত হলাম এবং দু'একজন অফিসার ও জেসিও'র দ্বিধাদ্বন্দ্ব আমাকে সিদ্ধান্তে অবিচল থাকা থেকে বিরত করতে পারে নাই। প্রসংগত উল্লেখযোগ্য যে, আমার চেষ্টা সত্ত্বেও দুপুরের পরে খালেদ মোমাররফের সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারিনি।

 ২৬শে মার্চ সন্ধার পরে ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণ শুণে আমার বাঙ্গালী জুনিয়র অফিসাররা আরো উত্তেজিত এবং ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল এবং আমাকে তক্ষুনি অস্ত্র হাতে তুলে নেবার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল। আমি রাতে আমার তাঁবুতে অবস্থান করলাম। সারারাত সাদেক নেওয়াজ এবং লেঃ আমজাদ আমার তাঁবুর ১০০/১৫০ গজ দূর থেকে আমাকে পাহারা দিচ্ছিল। আমার অজ্ঞাতেই তিন চারজন এনসিও (শহীদ হাবিলদার বেলায়েত হোসেন, শহীদ হাবিলদার মইনুল, হাবিলদার শহীদ মিয়া এবং হাবিলদার ইউনুস) সারারাত আমাকে পাহারা দেয় যাতে ঐ দুজন পাঞ্জাবী অফিসার আমার উপর কোন হামলা করতে না পারে। পাঞ্জাবী অফিসাররাও সারারাত সজাগ ছিল।

 ২৭শে মার্চ সকাল সাতটায় আমি লেঃ আখতারকে সাদেক নেওয়াজের কক্ষে পাঠাই এবং তাকে বলা হয় যখন সাদেক নেওয়াজ মেসে আমাদের সাথে নাস্তা করতে আসবে তখন যেন তার স্টেনগান এবং ৮ ম্যাগাজিন গুলী অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। আমার উদ্দেশ্য ছিল রক্তপাতহীন একটা এ্যাকশন পরিচালনা করা। কিছুক্ষণ পর আমি, লেঃ হারুন আর লেঃ কবীর দুইজন এন- সি- ও সাথে করে অফিসার মেসের দিকে যাই। অফিসার মেসে পাঞ্জাবী অফিসারদের সাথে আমরা ব্রেকফাস্টে মিলিত হই। এন- সি- ওদের নির্দেশ দিই যে, আমাদের রক্তপাতহীন এ্যাকমনের সময় যদি কোন বাঙ্গালী বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে তাকে যেন গুলী করে হত্যা করা হয়। আমরা সকাল ৭-২০ মিনিটে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে আছি। এমন সময় একজন জেসিও খিজির হায়াত খানকে বলল যে, সাদেক নেওয়াজের কোম্পানীতে একটু মনোমালিন্য হয়েছে সুতরাং খিজির হায়াতকে সাদেক নেওয়াজের কোম্পানীতে এক্ষুনি যেতে হবে। একথা শোনা মাত্র খিজির হায়াত খান তক্ষুনি সাদেক নেওয়াজের কোম্পানীর কাছে যেতে উদ্যত হল। আমি তাকে বাধা দিলাম এবং বললাম যে, পরিস্থিতি না জেনে এভাবে যাওয়া ঠিক হবে না। সুতরাং প্রথমে আমরা অফিসে যাই। ওখানে আলাপ- আলোচনার পর আমরা সকলেই সাদেক নেওয়াজের কোম্পানীতে যাব। খিজির হায়াত এতে রাজি হলেন। সাদেক নেওয়াজ তখন তার স্টেনগান