পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৩৩

আনার জন্য তার কক্ষে যেতে উদ্যত হয়। আমি আবার বাধা দিই এবং বলি যে আমার স্টেনগানটা সে যদি চায় তবে সে সঙ্গে নিতে পারে। এতে সে আশ্বত হয় এবং আমরা সকলেই অফিসে যাই। একটা তাঁবুতে অফিস করা হয়েছিল। তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার তাঁবুতে ঢোকা মাত্রই লেঃ কবীর আর লেঃ হারুন তাঁবুর দুপাশে গিয়ে দাঁড়ান এবং আমি আমাদের সকলের আনুগত্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ঘোষণা করি এবং বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে তাদেরকে বলি যে তারা আমাদের সকলের আনুগত্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ঘোষণা করি এবং বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে তাদেরকে বলি যে তারা আমাদের বন্দী। তদানুসারে তাদের জীবনের দায়িত্ব আমাদের এবং তারা যেন কেউ কোন বাঙ্গালী অফিসার, জে- সি-ও, এন- সি-ও সাথে কোন কথা না বলে। বলাবাহুল্য যে, পশ্চিম পাকিস্তানী ১২/১৫ জন সৈনিক যারা চতুর্থ বেঙ্গল- এর সাথে ছিল আমার নির্দেশের অপেক্ষা না করেই প্রায় একই সময়ে তাদেরকে বন্দী করে এক জায়গায় জমা করে রাখা হয়। বিনা রক্তপাতে আমাদের এ্যাকশন সম্পন্ন হয় এবং চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টর প্রায় সব কটা কোম্পানী তার সম্পূর্ন তার সম্পূর্ণ অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, যানবাহন, রসদপত্র নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

 ২৭শে মার্চ সকাল দশটার দিকে প্রায় ১০/১৫ হাজার উল্লসিত জনতা আমাদের ক্যাম্পে চলে আসে এবং ‘জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে আমাদের স্বাগত জানায়। অস্ত্র ধারণ করার পর দেখতে পেলাম আমার বেশ কয়েকজন অফিসার, জেসিও এবং এনসিও একটু অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ছিলেন এই অল্প সময়ের মধ্যে জীবনের এই বিরাট পরিবর্তনে। কয়েকজনের ক্ষণিকের মধ্যে ১০২ থেকে ১০৪ ডিগ্রি জ্বর পর্যন্ত হয়েছিল। কয়েকজন আবোল- তাবোল বকছিল। দুইজন অফিসারকে বেশ কয়েকদিন আর চোখে পড়েনি। আমি নিজেও একটু অস্থির প্রকৃতির হয়ে পড়েছিলাম।

 সকাল ১১টার দিকে আমি সব কোম্পানীকে নির্দেশ দিলাম তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের চার পাশের গ্রামগুলোতে যেন অবস্থান নেয় যাতে করে পাকিস্তানী বিমান হামলা থেকে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন না হয়। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে আমাদের ব্যাটালিয়ন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চারিপার্শ্বের গ্রাম গোপনে অবস্থান নেয়। বেলা আড়াইটার সময় মেজর খালেদ মোশাররফ তাঁর কোম্পানী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছেন। রাস্তায় হাজার হাজার বেরিকেড অতিক্রম করে আসার ফলে তাঁর আসতে দেরী হয়েছিল। তিনি আসা মাত্রই আমি চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্ত এলাকা তাঁর কাছে হস্তান্তর করি এবং তাঁর নির্দেশে পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়।

 কুমিল্লা সোনানিবাসে আমাদের যে সমস্ত লোক ছিল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা আমাদের সম্ভব হয়নি। সুতরাং তাদেরকে ২৭শে মার্চ বলতে পারিনি যে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করেছি। যা হোক, কর্নেল খালেদ মোশাররফ ২৯শে মার্চ জাঙ্গালীয়াতে আমাদের প্লাটুনের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন এবং তদেরকে আমাদের সংগ্রামের কথা জানান এবং নির্দেশ দেন জাঙ্গালীয়া থেকে বেরিয়ে এসে ব্যাটালিয়নে যোগদান করতে।

 আমরা পরে জানতে পেরেছি যে কুমিল্লা সেনানিবাসে আমাদের যে সমস্ত লোকজন ছিল তারা ২৯শে মার্চ আমাদের সংগ্রামের কথা জানতে পেরেছিল। কিন্তু নেতৃত্বের অভাবে তারা কোন এ্যাকশন নিতে পারেনি। ৩১শে মার্চ বিকাল চারটার সময় সেনানিবাসে অবস্থিত চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের ৭০/৮০ জন সৈনিকের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীরা চারিদিক থেকে হামলা করে এবং প্রায় ছয় ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ইউনিট লাইন দখল করে। এই যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানীদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। চতুর্থ বেঙ্গলের ৮/১০ জন জোয়ান শহীদ হন। এই যুদ্ধে নায়েব সুবেদার এম, এ, সালাম অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন।

 জাঙ্গালিয়াতে যে প্লাটুন ছিল সেটা ২৯শে মার্চ বের হয়ে মুক্তিসংগ্রামে যোগ দেয় এবং কুমিল্লা- লাকসাম রোডে নায়েব সুবেদার এম, এ, জলিলের নেতৃত্বে কয়েকটি সাফল্যজনক এ্যামবুশ করে।