পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৩৮

 আমি যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পৌঁছাই তখন করোলা ব্রীজের কাছে দিয়ে জীপ যেতে দেখি। ঐ জীপটিকে আমি থামালাম। ঐ জীপে কয়েকজন বাঙালী সৈন্য এবং একজন ক্যাপ্টেন মাহমুদুল হাসান (পাঞ্জাবী) ছিল। আমি দূর থেকে বাঙালী সৈন্যদের ক্যাপ্টেন মাহমুদুল হাসানকে গ্রেফতার করতে বলি। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাঙালী সৈন্যরা তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। ক্যাপ্টেন কৌশলে গাড়ি ব্যাক করে পালিয়ে যায়। কিন্তু ২৮ তারিখে ঐ ক্যাপ্টেন যখন বিকালে পুনরায় কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে আসছিল তখন করোলা ব্রীজের নিকট ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সৈন্যরা তাকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। ঐ গাড়িতে তিনজন বাঙালী সৈন্য মারা যায় ও দুজন আহত হয়। ঐ ক্যাপ্টেন মুসলমান ছিল, তাই বাঙালীরা দায়পরবশ হয়ে তার মৃতদেহ মুসলমান কায়দায় রাত আড়াইটায় কবর দেয়। এ ধরনের কবর দেয়া প্রথম ও শেষ। তারপরে আর কোথাও মৃতদেহকে মুসলিম কায়দায় কবর দেয়া হয়নি। (শত্রুদের আনুষ্ঠানিকভাবে কবর দেয়া নাকি জেনেভা কনভেনশনে আছে)।

 ২৮ তারিখে আমি ৪ জন অফিসারসহ অন্যান্য সৈন্য নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ডিফেন্স নিই। ২৭ তারিখে রওনা হয়ে খালেদ মোশাররফ সাহেব শ্রীমঙ্গল থেকে পুরা কোম্পানী নিয়ে ২৮ তারিখ সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছান এবং আমাকে বলে যান, যদি কোন এম-এন-এ বা কোন বুদ্ধিজীবী আসেন তাহলে তাদের আমার (খালেদ মোশাররফ) সাথে যোগাযোগ করার জন্য যেন সিলেট তেলিয়াপাড়া টি এস্টেটে পাঠিয়ে চলে যান। খালেদ মোশাররফ সাহেব ২৮ তারিখেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট তেলিয়াপাড়া টি এস্টেটে চলে যান। তেলিয়াপাড়ায় খালেদ মোশাররফ সাহেব ক্যাম্প খোলেন।

 ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের পতাকা ওড়ে এবং স্থানীয় প্রশাসন ঠিকভাবে চলে। ঐ সময় এস-ডি-ও ছিলেন রকিবউদ্দিন আহমেদ। তিনি তখন স্থানীয় প্রশাসক হন।

 ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে রক্ষা করার জন্য গোকনঘাটে ক্যাপ্টেন আবদুল গাফফার, ক্যাপ্টেন শহীদ ও মাহবুবুর রহমানকে ঐ ঘাট দেখাশোনার জন্য মোতয়েন করা হয়েছিল; কারণ ঐ নদীপথে পাক সৈন্যরা জাহাজে করে সৈন্য আনতে পারত। গোকন্যাট চিল একটি লঞ্চঘাট। সৈন্যরা করোলা নদীর আশেপাশে ডিফেন্স নিয়ে ছিল। তাদের তত্ত্বাবধান করেন সেকেণ্ড লেফটেন্যাণ্ট হারুনর রশীদ।

 ২৯ তারিখে বিকাল ৪টার দিকে পাকবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিমান থেকে দেড়-দুঘণ্টা ধরে বোমাবর্ষণ করে। এর ফলে একজন বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সৈন্য শহীদ হয়। কিন্তু বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কাছে তেমন কোন অস্ত্র না থাকায় শুধু ট্রেঞ্চের ভিতর বসে থাকতে হয়।

 ৩১ তারিখে আখাউড়া থেকে তৎকালীন ইপিআর (বর্তমানে বিডিআর) নায়েক সুবেদার গোলাম আম্বিয়া আমার সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি আখাউড়াতে ডিফেন্স নিয়েছিলেন। আখাউড়াতে ইপি আর- এর সৈন্যরা পাঞ্জাবীদের ঘেরাও করে রাখে। তারপর ৩১ তারিখে সারাদিন গোলাগুলী হওয়ার পর কিছু পাঞ্জাবী সৈন্য মারা যায় ও কিছু ধরা পড়ে। কিন্তু ৭ জন পাঞ্জাবী পালিয়ে যায়। তারপর ঐ ৭ জন পাঞ্জাবী সৈন্যকে গ্রামের ভিতর বাঙালীরা ধরে মেরে ফেলে।

 ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে যে সমস্ত পাঞ্জাবী অফিসার ধরা পড়ে তারা হলোঃ ১) লেঃ কর্নেল খিজির হায়াৎ খান, ২) মেজর সাদেক নেওয়াজ, ৩) লেফটেন্যাণ্ট আমজাদ সাইদ। তাদেরকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে নবীনগর, শাহবাজপুর, সরাইল হয়ে তেলিয়াপাড়া নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর তাদেরকে ভারতীয় সৈন্যদের কাছে দিয়ে দেয়া হয়। তাদেরকে বাঙালীরা হত্যা করতে পারত কিন্তু ঐ পাঞ্জাবী অফিসাররা কোনদিন বাঙালীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি বা বেঈমানি করেনি।