পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৪০

ক্যাণ্টনমেণ্টে বিপুলসংখ্যক পাকসৈন্য রয়ে গেছে। ঐ পাকসৈন্যের সাথে যুদ্ধ করে পারা যাবে না, এর ফলে অনেক সৈন্য মারা যাবে। শেষ পর্যন্ত মেজর খালেদ মোশাররফ সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন পাকসেনাদের গেরিলা পদ্ধতিতে ঘায়েল করতে হবে।

 ১৪ তারিখে পাকসেনা ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বিমান থেকে গুলি করে; ফলে কিছু পাবলিকসহ কিছু বাঙালী সৈন্য মারা যায়। এ সংবাদ খালেদ মোশাররফ সাহেব পেয়ে জানালেন যে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে যেন বেঙ্গল রেজিমেণ্ট আখাউড়া চলে আসে। ঐ তারিখে পাকসৈন্য প্যারাট্রুপার ফেলে আশুগঞ্জের পিছনের দিক থেকে আক্রমণ করে। এর ফলে মেজর নাসিম সাহেবের কিছু সৈন্য শহীদ হয়। ১৪ তারিখ সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত আশুগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বিমান আক্রমণ চলে। এর পরে আশুগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাথে কোন রকম টেলি-যোগাযোগ বা কোনরকম যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।

 ১৪ই এপ্রিল আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ব্যাংক থেকে (ইস্টার্ন মার্কেণ্টাইল ব্যাংঙ্ক) ম্যানেজারকে বাড়ি থেকে ডাকিয়ে ব্যাংক খুলে ২ কোটি টাকা নিয়ে যাই। ঐ টাকা ঐদিন তেলিয়াপাড়ায় মেজর সফিউল্লাহ সাহেবের কাছে জমা দিই। ১৪ তারিখে সারাদিন বিমান আক্রমণ হচ্ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে। এ সমস্ত প্রতিকূল অবস্থার ভিতরেও আমি বীরত্বের সাথে এ কাজ সমাধান করি। আমি বিকালেই তেলিয়াপাড়া থেকে ফিরে এসে দেখি আমার বাহিনী কিছু কিছু আখাউড়া চলে এসেছে। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে দুখানা মূল্যবান অয়ারলেস সেট নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সড়ক পথে তেলিয়াপাড়া হয়ে আখাউড়া চলে আসি।

 ১৫ই এপ্রিল মেজর খালেদ মোশাররফ আমাকে বলেন, আমাকে আখাউড়ায় সৈন্যদের দেখাশোনা করতে হবে। আখাউড়াতে ৩০/৪০ জন সৈন্য ছিল। আমি ১৫ তারিখে আমার বাহিনীকে বিকালে গঙ্গাসাগরের দিকে মুখ করে ডিফেন্স নেবার কলাকৌশল দেখিয়ে দিই। ১৫ তারিখ রাতে কুমিল্লা থেকে রেলে করে পাকসৈন্য গঙ্গাসাগর আসে এবং গঙ্গাসাগরের ব্রীজের দক্ষিণ পারে বাজারের দিকে তারা ডিফেন্স নেয় এবং বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ব্রীজের উত্তর দিকে অর্থাৎ আখাউড়ার দিকে ডিফেন্স নেয়। ১৬ ই এপ্রিল সকালে যেখানে ব্রীজের নিকট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ডিফেন্স নিয়েছিল, সেখানে ঐ সৈন্যদের সাথে দেখা করার জন্য আমি ক্রলিং করে যাচ্ছিলাম। পাকসৈন্যরা আমাকে দেখে আমার দিকে অবিরাম গুলীবর্ষণ করতে থাকে, কিন্তু আমি ঐ ঝুঁকি নিয়ে ট্রেঞ্চে গিয়ে সৈন্যদের বলে আসি পাক বাহিনীকে হত্যা করে যখন তাদের সংখ্যা কমে আসবে এবং বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ট্রেঞ্চের কাছে চলে আসবে ঠিক তার অল্প কিছুক্ষণ আগে যেন তারা বিওপিতে চলে আসে।

 ১৩ এপ্রিল গঙ্গাসাগরের এক পারে বেঙ্গল রেজিমেণ্ট এবং অপর পারে পাকবাহিনী অবস্থান করছিল। ঐ দিন বিকালে ৪টা থেকে পাকবাহিনীর গোলন্দাজ বাহিনী আধ ঘণ্টা বোমাবর্ষণ করে থেমে যায়।

 বিকাল ৬টা থেকে পাকবাহিনী আবার গোলা ছুড়তে থাকে এবং আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসতে থাকে। বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সেনারা অনেকক্ষণ যুদ্ধ করে এবং বহু পাকসেনাকে খতম করে শেষে পাকসেনাদের সামনে টিকতে না পেরে সব বেঙ্গল রেজিমেণ্ট সৈন্য পিছনের দিকে চলে আসে। বাকি ছিল মাত্র সিপাই মোস্তফা কামাল; সে আর ফিরে আসে নাই। তার হাতে ছিল একখানা এল-এম-জি ও ৮ হাজার গুলী। তার সাথে যে ২ জন সেনা ছিল তারাও চলে গেল। কামাল ট্রেঞ্চের ভিতর থেকে যুদ্ধ করতে থাকে। তার গোলায় পাক বাহিনীর তিনজন অফিসার মরে ও ২ জন আহত হয়। সবসুদ্ধ প্রায় সাড়ে তিনশ' সৈন্য খতম হয়। কামালের গুলি যখন ফুরিয়ে যায় তখন শত্রুসেনারা মাত্র ৫০ গজ দূরে ছিল, তবু সে পিছনে ফিরে আসে না। দূর থেকে পাকসেনা চীৎকার করে কামালকে আত্মসমর্পণ করতে বলে, কিন্তু কামাল তা করে নাই। পরে যখন পাকসেনারা ক্রলিং করে কামালের ট্রেঞ্চের কাছে আসে, কামাল তার শেষ সম্বল দু'খানা গ্রেনেড দিয়ে কিছু পাকসেনাকে আহত করে। শেষ পর্যন্ত কামাল পাকসেনাদের কাছে ধরা পড়ে। পাকসেনারা তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। প্রায় সাড়ে তিনশত