পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



১৫৩

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড

  ৩০শে এপ্রিল তারিখে পাকিস্তানী সৈন্যরা যখন দ্বিতীয়বার বড়কামতা আক্রমণ করল তখন শুধু মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারাই তাদের সঙ্গে মোকাবিলা করেনি, বহু সাধারণ মানুষ সেদিন এ লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিল, এ কথা আমরা সেই মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধার মুখে আগেই শুনেছিলাম। আমাদের চান্দিনার সেই পরিচিত কৃষক কর্মটির মুখে শুনলাম প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার কৃষক সেদিন এ লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিল।

 পরদিন ১লা মে তারিখে গতদিনের পরাজয়ের ঝাল মেটাবার জন্য সকাল দশটায় প্রায় হাজারখানেক পাকসেনা পুনরায় এই অঞ্চলে আসে। গতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে তাদের মনে এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে, এই এলাকায় মুক্তিবাহিনীর বেশ বড় রকমের ঘাঁটি রয়েছে। তাদের সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেবার সঙ্কল্প নিয়ে তারা বেশ বড়রকমের প্রস্ততি নিয়ে এখানে এসে হামলা করল। তারা চান্দিনার দুই মাইল পূর্বে কোরপাই থেকে আরম্ভ করে চান্দিনার এক মাইল পশ্চিমে হাটখোলা পর্যন্ত সমস্ত পাকা রাস্তায় পজিশন নেয়। তাছাড়া কিছু দূরে মেশিনগান ও কামান পেতে রাখে। তিন-চার শ” পাকসেনা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে এবং বাড়িগুলি আগুন দিয়ে জুলিয়ে দিতে থাকে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা তখন ঘটনাস্থল থেকে বহু দূরে সরে গিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে হামলাকারীরা বুঝতে পারল যে, তাদের হাতের শিকার ফসকে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত চারদিককার গ্রামবাসীদের উপর মনের ঝাল মিটিয়ে এই রক্তখাদক মানুষশিকারীর দল তাদের ক্যাণ্টনমেণ্টে ফিরে চলে গেল।

॥মুক্তিযুদ্ধে ফেনী ॥

 এপ্রিলের প্রথমভাগেই নোয়াখালীর ফেনী শহরে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল। বেঙ্গল রেজিমেণ্টের মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন এই বাহিনীর সংগঠক ও নায়ক। বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ও ই-পি-আর বাহিনীর জওয়ানরা, পুলিশ, আনসার, ছাত্র, সাধারণ মানুষ-এরা সবাই এই বাহিনীতে সামিল হয়েছিল। হাতিয়ার বলতে এদের কিছু রাইফেল আর বন্দুক। তাছাড়া বর্শা, বল্লম, লাঠিসোটা ইত্যাদিও ছিল। এই অস্ত্র সম্বল করে, সবকিছু জেনেশুনেও তারা কামান, মর্টার আর মেশিনগানের বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য তৈরি হয়েছিল। তখন তারা ভাবতেও পারেনি যে, এর চেয়েও মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে ওরা তাদের উপর হামলা করবে। কিন্তু যখন সে সময় এর, তখন তাতেও পিছ-পা হয়নি তারা।

 মুক্তিবাহিনী প্রস্ততি নেবার জন্য বেশী সময় পায়নি। এপ্রিলের প্রথম দিকেই আক্রমণকারী পাক-সৈন্যের একটি দল ফেনী শহর দখল করার জন্য মার্চ করে এগিয়ে এল। কিন্তু কাজটাকে যত সহজ বলে মনে করেছিল তা-ঠিক নয়, কার্যক্ষেত্রে সেটা প্রমাণিত হয়ে গেল। ওরা ফেনী শহরে এসে পৌছবার আগেই মুক্তিবাহিনী তাদের পথ রোধ করে দাঁড়াল। যাকে বলে মুখোমুখি লড়াই তা নয়, মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা নিজেদের আড়ালে রেখে নানা দিক দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে শত্রপক্ষকে এমনভাবে অস্থির করে তুলল যে, শেষ পর্যন্ত ওরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পেছনে হটে যেতে বাধ্য হোল। এই গেল প্রথম রাউণ্ড। কিন্তু প্রথম রাউণ্ডেই জয়-পরাজয়ের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হোল না। এরপর দু'পক্ষের মধ্যে পরপর কয়েকবার সংঘর্ষ ঘটল। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে আক্রমণকারীদের মুখ চুন হয়ে গেল। এই দুর্গম পথে, এই জীবনপণ করা দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা সহজ কথা নয়, তা করতে গেলে যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। এই সত্যটা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ওরা তখনকার মত স্থলপথে আক্রমণের কাজটা স্থগিত রাখল।

 এইভাবেই মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রথম অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। কিন্তু যুদ্ধবিদ্যায় অভিজ্ঞ মেজর জিয়াউর রহমান এবং তাঁর সহযোদ্ধারা একথা ভালভাবেই জানতেন, যুদ্ধের এইখানে ইতি নয়, সূচনা মাত্র। ওরা শীঘ্রই শক্তি বৃদ্ধি করে ফিরে আসবে। আত্মসন্তষ্টির অবকাশ নেই, এবার প্রবলতর আক্রমণের সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু সেজন্য ভয় করলে চলবে না। শক্রযতই প্রবল হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েই যেতে হবে, আত্মবিশ্বাসে উদ্দীপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এই দৃঢসংকল্প গ্রহণ করেছে। ফেনী শহর ও নিকটবর্তী