পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৫৪

গ্রামাঞ্চলে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড লাঠির ঘায়ে পিছিয়ে গিয়ে জঙ্গীবাহিনীর নেতারা ফেনী শহরকে আক্রমণ করার জন্য এবার এক নতুন পরিকল্পনা তৈরী করল।

 এপ্রিল মাসের মধ্যভাগ। একদিন হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে দুটো বিমান প্রচণ্ড গর্জন তুলে সারা শহরটাকে প্রদক্ষিণ করে চলল। ওরা শুধু অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেই আসেনি, বোমারু বিমান দুটো ঘুরে ঘুরে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তর উপর বোমা ফেলে চলেছে। বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে সারা শহর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। সাধারণ মানুষ এমন একটা আকস্মিক ঘটনার জন্য একেবারে প্রস্তুত ছিল না। তারা উদভ্রান্ত হয়ে ছুটোছুটি করতে লাগল। কিছু কিছু লোক হতাহতও হোল। এইভাবে কিছুক্ষণ বোমা ফেলে বিস্ফোরণ ঘটাবার পর সেই হিংস্র যন্ত্র-দানবগুলি স্বস্থানে ফিরে গেল।

 পরদিন আবার ওরা এল। এসেই আগেকার দিনের মতই বোমা ফেলে চলল। কিন্তু একটি দিনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শহরের সাধারণ মানুষ অনেক বেশী সাহস সঞ্চয় করেছে। বোমা বিস্ফোরণের মধ্যে কি করে আত্মরক্ষা করতে হয়, সেই কৌশলটাও তারা কিছুটা আয়ত্ত করে নিয়েছে। তারা দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মত ছুটোছুটি করছিল না, অথবা বহু লোক এক জায়গায় ভিড় করে দাঁড়িয়ে ওদের হাতে আক্রমণের সুযোগ তুলে দিচ্ছিল না, তারা ঠাণ্ডা মাথায় আত্মরক্ষা করে চলেছিল। আর মুক্তিযোদ্ধারা? মুক্তিযোদ্ধারা কি করছিল?

 সেই ধ্বংশলীলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে মেজর জিয়া নির্ভীক কণ্ঠে হেঁকে উঠলেন, মুক্তিবাহিনীর জওয়ান ভাইরা, আমরা মরবার জন্য তৈরী হয়েই দুস্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছি, তবে আর আমাদের ভয় কি! কুছপরওয়া নেই, আমরা ঐ বিমান দুটোকে পাল্টা আক্রমণ করে মাটিতে ফেলে ছাড়ব।

 মুক্তিযোদ্ধারা বিস্মিতকণ্ঠে প্রশ্ন করল, আমাদের হাতে তো এণ্টিএয়ারক্র্যাফট কামান নেই, আমরা কেমন করে এই বিমানগুলিকে ধ্বংশ করব?

 হ্যাঁ, এণ্টিএয়ারক্র্যাফ্ট থাকলে আমরা আগেই ওদের দফা রফা করে দিতে পারতাম। কিন্তু নাই-বা থাকল তা, আমাদের রাইফেল তো আছে। এই রাইফেল দিয়েই আমরা ওদের এমন শিক্ষা দেব, যা ওরা কোন দিন ভুলতে পারবে না। জওয়ান ভাইসব, শহরে যে-সমস্ত উঁচু দালান আছে, তাদের উপর উঠে ওদের তাক করে গুলি চালাতে থাক। ভিয়েতনামের মুক্তিযোদ্ধারা এইভাবে শত শত মার্কিন জঙ্গী বিমান ফেলে দিয়েছে, আমরাই বা কেন পারব না? এক মুহূর্ত দেরী নয়, জওয়ান ভাইরা, ছুটে চল সবাই।

 শুধু নির্দেশ দেওয়া নয়, মেজর জিয়া সবার আগে নিজেই রাইফেল বাগিয়ে ছুটলেন। রাইফেলধারী যোদ্ধারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ছুটতে ছুটতে শহরের উঁচু উঁচু দালানগুলির ছাদে গিয়ে উঠ পড়ল। এই দালানগুলি যেকোন সময় বোমার আগাতে ধসে পড়ে যেতে পারে, কিন্তু সেজন্য মনে বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই, বিন্দুমাত্র ভয় নেই। সবাই একমনে বিমান দুটোকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে চলেছে। তাদের এভাবে আক্রান্ত হতে হবে, বিমান চালকরা একথা কল্পনাও করতে পারেনি। তাই তারা নিশ্চিন্ত মনে রাইফেলের নাগালের ভেতরে এসে গিয়েছিল। তারা জানত যে, সে ক্ষেত্রে তারাই শুধু আক্রমনকারী। কিন্তু তারাও যে আক্রান্ত হতে পারে, এটা তাদের জানা ছিল না। কয়েকটা দালানের ছাদের উপর থেকে পায় একই সঙ্গে এক ঝাঁক রাইফেলের গুলি ছুটল। আর একই সঙ্গে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধারা তখনও গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। জলন্ত বিমানটার অবস্থা দেখে অপর বিমানটা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাল, দেখতে দেখতে আকাশপথে মিলিয়ে গেল। গুলিবিদ্ধ বিমানটা উল্কার মত জ্বলতে জ্বলতে পূর্বদিকে ছুটল। ওটা একটু বাদেই জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে যাবে।, পরে জানা গিয়েছিল, জ্বলন্ত বিমানটার ধ্বংসাবশেষ ত্রিপুরার সীমান্তে গিয়ে পড়েছিল।