জয়, মুক্তিবাহিনীর জয়! জয়, স্বাধীন বাংলা জয়! বিজয়গর্বে উদ্দীপ্ত হাজার হাজার জনতার জয়ধ্বনিতে ফেনী শহর মুখরিত হয়ে উঠল। সবাই মেতে উঠল উৎসবে। মুক্তনগরীর বুকে স্বাধীন বাংলার পতাকা পতপত করে উড়ছিল।
॥ চন্দ্রগঞ্জের যুদ্ধ ॥
মুক্তিবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের চর এসে সংবাদ দিল, সামরিক ভ্যান-বোঝাই একদল পাকসৈন্য ফেনী থেকে চন্দ্রগঞ্জের দিকে আসছে। ওদের যখন চন্দ্রগঞ্জের দিকে চোখ পড়েছে, তখন ওরা সেখানে লুটপাট না করে ছাড়বে না। খবর পেয়ে লাফিয়ে উঠলেন সুবেদার লুৎফর রহমান। বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লুৎফর রহমান, যিনি এই অঞ্চলে একটি মুক্তিবাহিনী গঠন করেছিলেন। সৈন্যদের সংখ্যা পঞ্চাশ-ষাট জনের মত হবে। এদের প্রতিরোধ করতে হলে দলে কিছুটা ভারী হয়ে নেওয়া দরকার। খোঁজ খবর করে অল্প সময়ের মধ্যে মাত্র ছয়জন মুক্তিযোদ্ধাদের জড় করা গেল।
সাতজন মানুষ সাতটি রাইফেল। এই সামান্য শক্তি নিয়ে ওদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে যাওয়াটা ঠিক হবে কি? মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজন এই প্রশ্নটা তুলেছিলেন। কথাটা মিথ্যা নয়, এটা একটা দুঃসাহসের কাজই হবে। অথচ হাতে, সময় নেই, মুক্তিবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য যে-সময়ের প্রয়োজন, তার মধ্যে এই লুণ্ঠনকারী দস্যুরা এদের কাজ হাসিল করে সরে পড়বে। চোখের সামনে এই ঘটনা ঘটে যাবে, আর তারা বসে বসে তাই দেখবে? না, কিছুতেই না, গর্জে উঠলের সুবেদার লুৎফর রহমান, যেভাবেই হোক এদের প্রতিরোধ করতেই হবে। আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ওরা অক্ষতভাবে হাসতে হাসতে চলে যাবে, এ কিছুতেই হতে পারে না। ওরা আমাদের অনেক রক্ত নিয়েছে, তার বিনিময়ে ওদেরকেও কিছুটা রক্ত দিতে হবে।
রাস্তার ধারে একটা বড় রকমের ইটের পাঁজা। কে যেন করে একটা দালান তোলবার জন্য এখানে এই ইটগুলি এনে জড় করে রেখেছিল। অনেকদিন হয়ে গেল, সেই দালান এখনো তোলা হয় নি, ইটগুলি যেমন ছিল তেমনি পড়ে আছে। চন্দ্রগঞ্জে ঢুকতে হলে সৈন্যবাহী গাড়ীগুলিকে এই রাস্তা দিয়েই যেতে হবে। সুবেদার লুৎফর রহমান আর ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা সেই ইটের পাঁজার পেছনে পজিশন নিয়ে দাঁড়ালেরন। এখানে থেকেই তাঁরা সেই হামলাকারী দস্যুদের প্রতিরোধ করবেন, এটা খুবই দুঃসাহসের কাজ। তাঁরা জানতেন, তাঁরা তাঁদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চলেছেন। কিন্তু এমন এক একটা সময় আসে যখন জেনেশুনে বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন। অবস্থাবিশেষে বামন হয়েও তাঁদের দানবের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করতে হয়। মুক্তিবাহিনীর নায়েক সুবেদার লুৎফর রহমান বললেন, এখনকার অবস্থা হচ্ছে তেমনি এক অবস্থা।
কিন্তু বেশি কথা বলার সময় ছিল না। দূরে থেকে অস্ফুট সামরিক ভ্যানের গর্জন শোনা গেল। ঐ যে, ঐ যে আসছে ওরা! তাঁরা সাতজন সাতটি রাইফেল নিয়ে তৈরী হয়ে দাঁড়ালেন। সেই অস্ফুট আওয়াজ ক্রমেই স্ফুট থেকে স্ফুটতর হয়ে উঠতে লাগল। তারপর একটু বাদেই দেখা গেল সামরিক ভ্যান পথের ধুলো উড়িয়ে দ্রুতবেগে ছুটে আসছে। উত্তেজিত প্রতীক্ষায় তাঁদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি যেন ইস্পাতের মত দৃঢ় আর কঠিন হয়ে এল।
সামরিক ভ্যান দ্রুত আসতে হঠাৎ থেমে গেল। না থেমে উপায় ছিল না, কাদের অদৃশ্য হস্তের গুলিতে গাড়ির টায়ারের চাকা ফুটো হয়ে গেছে। একই সঙ্গে কতগুলি রাইফেলের আওয়াজ। বিস্ময়ে, আতঙ্কে সৈন্যরা ঝুপঝাপ করে গাড়ি থেকে লাফিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল। কিন্তু সেই অদৃশ্য হস্তের গুলিবর্ষণের যেন শেষ নেই। সৈন্যদের মধ্যে যারা সামনের দিকে ছিল, তাদের মধ্যে অনেকে হতাহত হয়ে ভূমিশয্যা নিল। একটু বাদেই রাইফেলের আওয়াজ থেমে গিয়ে পল্লী-প্রকৃতির নিস্তব্ধতা আর শান্তি ফিরে এল।