পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৬৮

 স্টেশনে ঢাকা থেকে এসেছেন এবং সেখানে বসে আছেন। তিনি আমার সাথে বা লেঃ কর্নেল মাসুদের সাথে দেখা করতে চান। আমি ঐ লোকটার সঙ্গে গোপনে দেখা করি এবং লেঃ কর্নেল মাসুদ ব্যাটালিয়নে নেই, উনি ঢাকায়। বর্তমান ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল রকিব। আপনি চলে আসুন, কোন অসুবিধা হবে না। বোধ হয় লেঃ কর্নেল রকিব ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার শুনে জয়দেবপুর আসতে সাহস পাননি। তাই তার সঙ্গে আর দেখা হয়নি।

 ২৮ শে মার্চ সকালে ময়মনসিংহ থেকে মেজর নুরুল ইসলাম আমাকে খবর পাঠায় যে ২৭/২৮ শে মার্চ রাতে তার সেনাবাহিনীর উপর পাকিস্তানী ইপিআররা হামলা চালিয়েছে। লড়াই এখনো চলছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমি ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডারকে বললাম যে, আমাদের শিগগিরই ময়মনসিংহ রিইনফোর্সমেণ্ট পাঠানো দরকার। আমরা শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত নেই যে, যেহেতু ঢাকার সাথে আমাদের যোগাযোগ বিছিন্ন এবং ময়মনসিংহে আমাদের সৈন্যরা আক্রান্ত হয়েছে, সেহেতু আমাদের এখন তাদের সাহায্যে যাওয়া উচিত। ময়মনসিংহে যে আমাদের সৈন্যরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে একথা আমরা কাউকে বলিনি। আমাদের একথা গোপন রাখার একমাত্র উদ্দেশ্যে ছিল যে জয়দেবপুর থেকে সবাইকে এক সাথে নিয়ে যাওয়া এবং পথিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার ও সৈনিকদের নিরস্ত্র করা। এ ব্যাপারে আমরা এক পরিকল্পনা তৈরী করি। রাতে যাবার পরিকল্পনা এ জন্য করা হয়েছিল যে গাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুরে আমাদের যে সব সৈনিকরা আছে তাদেরকেও যদি সাথে নিয়ে না যাই তাহলে তারা হয়ত আটকা পড়বে। যেহেতু দিনের বেলায় তাদের সরাতে গেলে অসুবিধা হতে পারে সেহেতু রাতে তাদেরকে সরানোর সময় বেছে নেয়া হয়। কেননা, গাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুরে যে সমস্ত বাঙ্গালী সৈন্য আছে তাদেরকে গোপনে সংবাদ দিতে হবে। আমরা যে জয়দেবপুর থেকে যাচ্ছি এটা সবাই জানত। কিন্তু গাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুর সৈন্য সরাতে গেলে সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে এ জন্য রাতে যেন বাঙ্গালী সৈন্যরা গোপনে বের হয়ে আসতে পারে তার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। আরো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল যে, আমি সারপ্লাস অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং কিছুসংখ্যক সৈনিক নিয়ে সকাল দশটার দিকে ময়মনসিংহে যাত্রা করব। এবং লেঃ কর্নেল রকিব বাকী লোকদের নিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় রওনা হবেন। এই সময়টা যেন গাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুরকে জানিয়ে দেওয়া হয়, যাতে তারা যেন ঠিক ঐ সময় বেরিয়ে আসতে পারে। ওয়াপদার সাথে এটাও ঠিক হযেছিল যে, ঐ সময় গাজীপুর, রাজেন্দ্রপুর ও জয়দেবপুরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেবে- যাতে এ সমস্ত জায়গা থেকে আমাদের বের হতে কোন অসুবিধা না হয়। গাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুরে লোক পাঠিয়ে ওদেরকে ঐ সময়ের মধ্যে বের হবার খবর দেওয়া হয়েছিল।

 ২৮ শে মার্চ সকাল দশটায় সমস্ত উদ্বৃত্ত অস্ত্রশস্ত্র এবং যানবাহন নিয়ে আমি ময়মনসিংহ অভিমুখে যাত্রা করি। যাবার সময় লেঃ কর্নেল রকিব এই আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ব্যাটালিয়নের বাকী লোকদের নিয়ে তিনি সন্ধ্যার সময় রওনা হবেন। আমি জয়দেবপুর থেকে বের হবার পর চৌরাস্তা থেকে সমস্ত বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড্ডয়ন করি। সাথে সাথে সমস্ত জোয়ানদের মাঝে এক অভূতপূর্ব আনন্দের হিল্লোল সৃষ্টি হয় এবং সবাই উল্লাসে “জয় বাংলা” শ্লোগান দিতে থাকে। আমার কনভয় জয়দেবপুর থেকে বের হবার সাথে সাথে জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং আমাদেরকে “জয় বাংলা” শ্লোগান দিয়ে অনুপ্রাণিত করে। তাদের মধ্যে কিছু লোক জানত আমরা কি করছি। যে সমস্ত নেতৃস্থানীয় লোক আমাদের পরিকল্পনার কিছুটা আভাস পেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জনাব আবদুল মোতালেব। তিনি একজন শ্রমিক নেতা ছিলেন এবং আমাদের ব্যাটালিয়নের বাকী লোকদের যাবার জন্য বেসামরিক ট্রাক, বাস, গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন।

 টাঙ্গাইলের কাছাকাছি যাবার পর দেখতে পেলাম অপরদিক থেকে অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত একটা জীপ গাড়ী আসছে। ঐ গাড়ীটা আমাদের কনভয়-এর কাছে এসে দাঁড়ায় এবং আমাদের গাড়ীতে বাংলাদেশের পতাকা দেখে খুশী হয়। তারা বলে যে, আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। আমাদের লোকজন পজিশন নিয়ে আছে। আমরা তাদেরকে খবর দিয়ে আসি, যেন কোন অঘটন না ঘটে। কিছুক্ষণ পর আমরা টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করি। সেখানে ব্যাণ্ডপার্টিসহ এক উৎফুল্ল জনতা আমাদের অভ্যর্থনা করে। জনতার এই উৎসাহ উদ্দীপনা দেখে