আমি খুবই অনুপ্রাণিত হই। কিন্তু মনে মনে শুধু একটা চিন্তা করছিলাম যে, আমি যা করতে চলেছি এ কাজে আমি কি শুধু একা? না আরো কেউ আছে? যদিও একদিকে খুশী ছিলাম, অপরদিকে ভাবনাও কম ছিল না। কারণ আমি জানি আমি যা করতে চলেছি তা যদি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তাহলে মৃত্যুদণ্ডই সাজা। কিন্তু তবু জনতার উৎফুল্লতা দেখে মনে উৎসাহের সঞ্চার হতো। টাঙ্গাইলে যাবার পর কে একজন আমাকে বললেন যে মেজর জিয়া নামে একজন চট্টগ্রাম থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এ কথা শুনে আমার সাহস দ্বিগুণ, ত্রিগুণ বেড়ে যায়। কারণ, তখন আমার মনে এ ধারণার সৃষ্টি হয় যে, এ কাজে আমি একা নই।
টাঙ্গাইলের জনগণ আমাদেরকে যেভাবে সাহায্য করেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এ্যামুনিশেন বোঝাই একটা গাড়ীর অ্যাক্সেল ভেঙ্গে যাবার সাথে সাথেই সে অ্যাক্সেল তারা বদলিয়ে দেয়। আমি আমার সমস্ত সৈন্য এবং যানবাহন নিয়ে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসে পৌঁছে যাই।
টাঙ্গাইলে আমাদের এক কোম্পানী সৈন্য ছিল, তার কমাণ্ডার ছিল একজন পাঞ্জাবী অফিসার। টাঙ্গাইল কোম্পানী হেডকোয়ার্টারে পৌঁছার সাথে সাথেই কোম্পানীর জেসিও আমাকে বলে যে, সে গত রাতে কোম্পানী কমাণ্ডারকে নিরস্ত্র করে রেখেছে। আমি তখন সমস্ত কোম্পানীকে একত্রিত করে লেঃ মোরশেদকে তাদের কোম্পানী কমাণ্ডার নিয়োগ করি। আর সমস্ত কোম্পানীকে এই বলি যে তোমরা সবাই ময়মনসিংহে চলে আস এবং ময়মনসিংহ পৌঁছার পর তোমাদের বাকী নির্দেশ দেব। এখন থেকে লেঃ মোরশেদ (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) তোমাদের কোম্পানী কমাণ্ডার আর তোমাদের কাছ থেকে এ ওয়াদা চাই যে তোমাদের কাছে আমি তোমাদের পুরাতন কোম্পানী কমাণ্ডারকে আমানত হিসেবে রেখে যাচ্ছি! তোমরা তাকে তোমাদের সাথে নিয়ে আসবে। এবং আমার কাছে ময়মনসিংহ পৌঁছাবে। যেহেতু আমি ময়মনসিংহ যাবার জন্য তাড়াহুড়াতে ছিলাম সেহেতু বেলা দুটোর দিকে আমি ময়মনসিংহ অভিমুখে রওনা হই। তাদেরকে এই নির্দেশ দিয়ে আসি যে, জয়দেবপুর থেকে লোক না আসার আগে তারা যেন টাঙ্গাইল ত্যাগ না করে।
টাঙ্গাইল থেকে কয়েক মাইল যাবার পর প্রথম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হই। এখানে বলে রাখা দরকার, ঢাকার খবর পাবার পরপরই জনসাধারণ টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত রাস্তার মাঝে মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাখে। প্রথম যে প্রতিবন্ধকতা আমি দেখতে পাই সেটা ছিল একটা কাঠের পুল। জনসাধারণ সেটাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। এবং আগুন তখনও জ্বলছিল। পুলটা একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই আমার কনভয়কে অনেক দূর ঘুরে কোন কোন জায়গাতে নতুন রাস্তা করে যেতে হয়েছিল। রাস্তায় রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা খুলে অগ্রসর হতে আমার বেশ সময় লেগে যায় এবং রাত প্রায় তিনটায় আমি মুক্তাগাছা পৌঁছি। মুক্তাগাছায়ও টাঙ্গাইলের মত কিছু লোক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাহারা দিচ্ছিল। তারা আমাদের উপর গুলি করার আগেই আমরা তাদেরকে বুঝাতে সক্ষম হই আমরা তাদের শত্রুনই। আমরা বাংলাদেশের সৈনিক। তখন বহু লোক বেরিয়ে আসে এবং রাস্তা দেখিয়ে দেয়। ঐ রাত আমরা মুক্তাগাছা কলেজে কাটাই। আমাদের সাথে খাবার ছিল না। জনসাধারণ আমাদের খাবার ব্যবস্থা করে।
ভোর হবার আগেই জয়দেবপুর এবং টাঙ্গাইলের লোকজন মুক্তাগাছায় পৌঁছে। মেজর মইন (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) আমাকে বলে যে সবাই এসে গেছে। আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার কোথায়। উত্তরে বলল সে আসে নাই। আমি জয়দেবপুর থেকে আসার পূর্বোল্লিখিত পরিকল্পনার কিছুটা রদবদল হয়েছিল। তা নিম্নরূপ আমাদের লোকদের জয়দেবপুর থেকে সরিয়ে আনার কথা ছিল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। কিন্তু ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার পরে মেজর মইনকে বলেছিলেন এ সময় বদলী করে ৮ টা করার জন্য। সময় ছিল বলে ঐ পরিবর্তিত সময় সবাইকে জানানো সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার মত ঠিক করতে পারছিলেন না। সন্ধ্যে সাতটায় মেজর মইনকে আবার বললেন যে সময়টা পরিবর্তন করে সাড়ে সাতটা করে দাও। মেজর মইন তাকে বলেছিলেন যে, এখন আর সবাইকে এই সময় সম্বন্ধে বলার সুযোগ হলো না, তাই এই সময়টা