পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৭০

অপরিবর্তিত থেকে যায়। রাত ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। বিদ্যুৎ বন্ধ ছিল। কেমন যেন একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছিল। রাত ঠিক ৮টায় অয়ারলেস, যেটা অফিসার্স মেস-এর পূর্বাংশে ছিল, সেখান থেকে একজন পাঞ্জাবী সৈনিক আমাদের একজন সিপাইকে লক্ষ্য করে গুলি করে। এই গুলির আওয়াজের সাথে সাথে চারিদিকে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। যেহেতু আমাদের লোক একজন অপরজনের উপর মোতায়েন করা হয়েছিল এবং তারা সজাগ ছিল সেহেতু আমাদের লোকের বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এই গোলাগুলিতে কিছুসংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানী সৈনিক মারা যায়। কথামত পৌনে ৮টায় প্যালেসের বাইরে যে জীপ গাড়ী দাঁড়ানো ছিল সে জীপে করে ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডারের যাবার কথা ছিল। কিন্তু সে সময় তিনি গাড়ীর কাছে না গিয়ে একজন পাঞ্জাবী অফিসারের সাথে অফিসার্স মেস-এর দ্বিতলে ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন। তাই হয়ত তিনি ঐ অফিসারের হাত থেকে সরে আসতে পারেননি। অথবা নিজে ইচ্ছে করে আসেন নি। কারণ ঐ সময় তাঁর ঐ জায়গাতে থাকার কথা ছিল না।

 গোলাগুলির পর ব্যাটালিয়ন-এর লোকজন সময়মত বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। গাজীপুর থেকে যখন লোক বেরিয়ে আসে তখন পাঞ্জাবী অফিসার বাধা দেওয়াতে তারা তাঁকে হত্যা করতে বাধ্য হয়। জয়দেবপুরের লোক টাঙ্গাইল পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে এক গোলযোগের সৃষ্টি হয়। গোলযোগের সূত্রপাত এভাবে হয়েছিল যে, জয়দেবপুর থেকে যখন বাঙ্গালী সৈন্যরা বেরিয়ে আসছিল তখন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। এ কথা বলার সাথে সাথে আমি যে অফিসারকে আমানত রেখে গিয়েছিলাম তার উপরে আক্রোশে গুলি চালানো হয় এবং সে মারা যায়।

 এ সমস্ত ঘটনার পর আমি দৃঢ়সংকল্প গ্রহণ করলাম যে আমাদেরকে এখন মৃত্যু পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

 ২৯ শে মার্চ সকালে মুক্তাগাছা থেকে ময়মনসিংহ যাত্রা করি। যদিও দূরত্ব ছিল মাত্র ১০ মাইল তবুও এই পথ অতিক্রম করতে আমাদের প্রায় তিন ঘণ্টা লেগেছিল। ময়মনসিংহ পৌঁছার সাথে সাথে মেজর নুরুল ইসলাম (বর্তমান লেঃ কর্নেল) বলল যে, গতকাল আড়াইটা পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরদের সাথে লড়াই করতে হয়েছে। এ লড়াইয়ে সবাই মারা গেছে, শুধু ছয়জন ছাড়া। আমাদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

 মেজর নুরুল ইসলাম আমাকে ময়মনসিংহের ঘটনার যে বর্ণনা দেন তা উল্লেখ করছি। ২৬ শে মার্চ ময়মনসিংহে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট-এর কোম্পানী ও ইপিআর-এর লোক জনসাধারণ কর্তৃক ঘেরাও হয়েছিল। তখন ইপিআর হেডকোয়ার্টার পেরিমিটারের বাইরে বাঙ্গালী সৈন্যরা পাহারা দিচ্ছিল। তারা জনসাধারণকে সরে যেতে বাধ্য করতে সক্ষম হয়েছিল। এতে উইং কমাণ্ডার (পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার) চালাকি করে বাঙ্গালী ইপিআর লোকদের বলে যে গতকাল তোমরা অনেক কষ্ট করেছ। আজ তোমরা রেস্ট কর। আজকের ডিউটি দেবে অন্য কোম্পানী (সে কোম্পানীটা ছিল সমস্ত পাঞ্জাবীদের)। আজ রাতে তোমাদের আর কোন ডিউটি হবে না। তোমরা হাতিয়ার জমা দিয়ে রেস্ট কর। যেহেতু চারিদিকে একটা থমথমে পরিবেশ ছিল সে কারণে কেউ হাতিয়ার জমা দেয়নি। সবাই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যার যার বিছানায় শুয়ে পড়ে। রাত প্রায় ১২টার মধ্যেই পাকিস্তানী ইপিআর-এর সৈনিকরা ইপিআর-এর যত অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ছিল তা তারা ছাদের উপর নিয়ে যায় এবং সমস্ত যানবাহন সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায় যাতে যখন সমস্ত গাড়ী স্টার্ট করতে হেড লাইট অন করে তখন যেন সমস্ত আলো ইপিআর-এর বাঙ্গালীর যে ব্যারাকে ঘুমাচ্ছে সে ব্যারাকের উপর পড়ে এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কোম্পানীর তাঁবুতে পড়ে। রাত প্রায় সাড়ে বারোটায় তারা টেলিফোন যোগাযোগ বিছিন্ন করে দেয়। মেজর নুরুল ইসলাম ও লেঃ মান্নান ইপিআর হেডকোয়ার্টার থেকে প্রায় আধ মাইল দূরে সি-এণ্ড-বি রেস্ট হাউসে ঘুমাচ্ছিলেন। রাত সাড়ে বারটায় রেস্ট হাউস-এর উপর তাদের কামরা লক্ষ্য করে অটোমেটিক গুলি ছোড়া হয়। প্রথমে তিনি টেলিফোনে কোম্পানীর সাথে কথা বলতে চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হয়ে তিনি এবং লেঃ মান্নান পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে নদীর দিকে চলে যান। এবং সেখান থেকে ময়মনসিংহ শহরে যান। সকাল