পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৭৭

নদীর উত্তরে সিলেট শহর শত্রুমুক্ত হয়ে আমাদের হস্তগত হয়। প্রাক্তন ইপিআর-এর কিছুসংখ্যক লোক যারা সুনামগঞ্জে ছিলেন তারাও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে সিলেটের দিকে অগ্রসর হয়। ঐ দিন পর্যন্ত আমাদের আয়ত্তাধীনে যে সমস্ত এলাকা ছিল তা হল: সমস্ত সুরমা নদীর দক্ষিণে এবং পশ্চিমে সমস্ত অঞ্চল, সিলেট শহর এবং খাদিমনগর। আমাদের কাছে সৈন্য ছিল মাত্র ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের এক কোম্পানী এবং প্রাক্তন ইপিআর-এর তিন কোম্পানী, যারা সমস্ত এলাকাকে ঘিরে রাখে। পাকিস্তানের যে সৈনিক ছিল তারা এক ব্যাটালিয়নেরও বেশী। তারা শালুটিকার বিমান ঘাঁটিতে একত্রিত হয়েছিল। পাকিস্তানীদের কাছে আধুনিক, মারাত্মক এবং ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল। যে ব্যাটালিয়ন সেখানে ছিল সেটা হল ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট।

 প্রথম পর্যায় শেষ করার পর আমি আমার সৈনিকদের নির্দেশ দিই, যে-এলাকা এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সেখানে যেন শত্রুরা ব্যুহ ভেদ না করতে পারে। সে জন্য সজাগ দৃষ্টি রেখে সে এলাকাকে সুরক্ষিত রাখতে বলি। দ্বিতীয় পর্যায় অপারেশন আমি সাথে সাথে শুরু করতে পারছিলাম না, এজন্য যে, শত্রুসন্যের সংখ্যা আমাদের চেয়ে অনেক বেশী ছিল। তাই সবাইকে পরিখা খনন করে বৃহ প্রস্তুত করতে বলি।

 পাক সৈনিকরাও তখন বেশ অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ছিল। তাদের মনোবলও লোপ পেয়েছিল। আত্মসমর্পণের ইচ্ছা থাকলেও তাদের মনে আশংকা ছিল যে, আত্মসমর্পণ করলে তাদের সবাইকে মেরে ফেলা হবে। তাই আত্মরক্ষার জন্য তারাও চারিপার্শ্বে পরিখা খনন করে ব্যুহ তৈরী করল। আমি তখন চিন্তা করছিলাম যে অন্য কোথাও থেকে এখানে সৈন্য আনা যায় কিনা। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং আশুগঞ্জ থেকে কোন সৈন্য সরাতে পারছিলাম না এইজন্য যে তখন নরসিংদীতে লড়াই চলছিল। পাকিস্তানীরাও তখন নীরব থাকেনি। তারা পিআইএ ফোকার ফ্রেণ্ডশীপ এবং সি-১৩০ বিমানের সাহায্যে সিলেটে রি-ইনপোর্সমেণ্ট শুরু করে। আমাদের শুধু সৈন্যই কম ছিল না, অস্ত্রশস্ত্রেরও অভাব ছিল যথেষ্ট। আরো অধিক সৈন্য কিভাবে যোগাড় করা যায় সে ব্যাপারে আলোচনার জন্য মৌলভীবাজারে মেজর দত্ত (বর্তমানে কর্নেল দত্ত) এবং এমএনএ মানিক চৌধুরীর সংগে মিলিত হই। এই সাক্ষাৎকার ঘটে ৮ই এপ্রিল। ঐ দিন শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে শত্রুকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য বেশকিছুসংখ্যক বেসামরিক লোককে একত্রিত করে পাকিস্তানীদের ব্যূহের পশ্চিমাংশ দিয়ে মহড়া দেখানো বা শো করানো যেন এই সুযোগে খাদিমনগরের দিক থেকে (পূর্ব দিক থেকে) জঙ্গলের ভিতর দিয়ে শালুটিকার বিমান ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালাতে পারি। এ সমস্ত লোক একত্রিত করার দায়িত্ব নেন এমএনএ মানিক চৌধুরী। ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত লোক যোগাড় করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু অন্যদিকে পাকিস্তানী রি-ইনফোর্সমেণ্ট বেশ হয়ে যায় এবং ৯ই এপ্রিল দিবাগত রাত্রে পাকিস্তনীরা আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে সারারাত লড়াই চলে এবং অবশেষে আমরা পিছনে হটতে বাধ্য হই। এ লড়াইয়ে আমাদের দুজন সৈনিক শহীদ হন এবং পাঁচজন আহত হন। যারা শহীদ হয়েছেন তারা হলেন হাওলাদার কাজী মোসলেহউদ্দীন ও ল্যান্সনায়েক আবদুর রহমান। শত্রুপক্ষেরও বেশ হতাহত হয়। তাদের দূরপাল্লার কামানের গোলার মুখে আমরা টিকতে পারছিলাম না। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানী জঙ্গী বিমানও আমাদের উপর আক্রমণ চালায়।

 সেখান থেকে আমরা পিছু হটে আবার শেরপুরে ব্যূহ নির্মান করি এবং ভবিষ্যতে যুদ্ধ পরিচালনার পরিকল্পনার জন্য আবার মৌলভীবাজারে মিলিত হই। ঐদিন কর্নেল ওসমানী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল), মেজর কাজী নূরুজ্জামানও (অবসরপ্রাপ্ত লেঃ কর্নেল) মৌলভীবাজারে উপস্থিত হন। যেহেতু আমাকে সিলেট ও নরসিংদীতে যুদ্ধের পরিকল্পনা তত্ত্বাবধান করতে হয়েছিল এবং নরসিংদীতে যুদ্ধ চলছিল। সেহেতু মেজন কাজী নূরুজ্জামান এবং মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তকে সিলেটের যুদ্ধের পরিচালনার ভার অর্পণ করা হয়। মেজর নূরুজ্জামান সিনিয়র হওয়াতে তাকে অধিনায়ক করা হয়। যে সমস্ত সৈন্য যুদ্ধের জন্য আমি সিলেট নিয়েছিলাম তাদেরকে রেখে আসি। ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট থেকে এক কোম্পানী সৈন্য সিলেট এবং এক কোম্পানী সৈন্য চিটাগাং পাঠাবার পর আমার নিকট মাত্র ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের দুই কোম্পানী সৈন্য থেকে যায়। তাদের দ্বারা আমাদের ঢাকা থেকে অগ্রসরমান এক ব্রিগেড পাকিস্তানী সৈন্যের মোকাবিলা করতে হচ্ছিল।