পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৭৯

নিকটবর্তী শাহবাজপুরে একত্রিত করি। শাহবাজপুর এলাকাটা প্রতিরক্ষার জন্য উপযোগী না হওয়ায় আমি সিলেটের মাধবপুরে আমার প্রতিরক্ষা ব্যূহ নির্মাণ করতে শুরু করি। আশুগঞ্জের যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছিলেন। তাঁরা হলেনঃ সুবেদার সিরাজুল ইসলাম, ল্যান্স নায়েক আব্দুল হাই, সিপাহী কফিলউদ্দীন, সিপাহী আব্দুর রহমান সরকার।

 ১৪/১৫ই এপ্রিল রাত প্রায় দুটায় শাহবাজপুরে তিতাস নদীর উপরে যে পুল ছিল তা ভেংগে দিই এবং তিতাস নদীর পূর্ব পারে শাহবাজপুরের কাছে একটা ব্যূহ নির্মাণ করি। যদিও ১৪ই এপ্রিল আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে দিতে হয়েছিল কিন্তু তবুও পাকিস্তানী সৈনিকরা দুই দিন পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে ঢোকেনি। এ দুদিন তারা অনবরত ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গোলাবর্ষণ করেছে। তারপর তারা আস্তে আস্তে শাহবাজপুরের দিকে অগ্রসর হয়। শাহবাজপুর দখল করার জন্য তারা স্থল এবং জল উভয় পথে আসে। ২১শে এপ্রিল তারা শাহবাজপুর দখল করে। যেদিন তারা শাহবাজপুর দখল করে সেদিন তারা আমাদের অবস্থানের উপর বেপরোয়াভাবে দূরপাল্লার কামার দিয়ে এবং জঙ্গী বিমান দিয়ে গোলাগুলি করে। আমাদের কাছে বিমান আক্রমণ প্রতিহত করার কোন অস্ত্র না থাকায় এবং পাকিস্তানী জঙ্গী বিমানের আক্রমণে আমাদের সৈনিকরা এতই আতংকিত হয়েছিল যে তারা বিমান দেখলেই ভয় পেয়ে যেত।

 পাক সৈন্যের শাহবাজপুর দখল করার সাথে সাথে আমি শাহবাজপুর থেকে তেলিয়াপাড়া পর্যন্ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার জন্য বেশ কিছুসংখ্যক পুল ভেংগে ফেলি। আমরা মাধবপুর বেশ বড় রকমের ব্যূহ তৈরী করি। মাধবপুর দখল করার জন্য পাকবাহিনী আমাদের উপর কয়েকবার আক্রমণ করে এবং শেষ পর্যন্ত ২৮শে এপ্রিল বেলা পাঁচটায় মাধবপুর দখল করে নেয়। এই আক্রমণ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী প্রায় দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য মোতায়েন করে। লড়াই সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়। পাক সেনাবাহিনী মাধবপুর আক্রমণের জন্য দূরপাল্লার ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে এবং যে গোলাবারুদ তারা ব্যবহার করে, তা ছিল হাই এক্সপ্লোসিভ এবং আগ্নেয় ধরনের। কাজেই সেখানে তাদের গোলা এসে পড়ত সেখানেই আগুন লেগে যেত। পরিখা এবং বাংকার তৈরী করে আমরা যে ব্যূহ তৈরী করেছিলাম সেটাও ছিল বেশ মজবুত। কিন্তু আমাদের সাথে রাইফেল, এলএমজি এবং মেশিনগান ছাড়া আর কোন ভারী অস্ত্র ছিল না। বেলা প্রায় ১২টার মধ্যে আমাদের অবস্থানের চার দিকে শুধু আগুন জ্বলছিল। তবুও আমাদের জোয়ানরা কেউই তাদের ট্রেঞ্চ এবং বাংকার ছেড়ে যায়নি। বাংকার এবং ট্রেঞ্চে বসে শত্রু নিপাত করছিল। বেলা প্রায় সাড়ে বারটায় পাকিস্তানী সৈনিকরা মাধবপুর দখল করার জন্য আমাদের অবস্থানের দিকে দলে দলে অগ্রসর হয় এবং ভীষণ যুদ্ধ বেধে যায়। আমাদের মেশিনগান, এলএমজি, রাইফেল তাদের অগ্রসর হতে দিচ্ছিল না। তাদের যে দলই সামনে অগ্রসর হচ্ছিল সে দলটিকেই গুলি করে ভূলুণ্ঠিত করা হচ্ছিল। মাধবপুরে যখন এভাবে মুখোমুখি যুদ্ধ চলছিল তখন আমি মাধবপুরে পশ্চিম পার্শ্ব দিয়ে অপর একটি ছোট সৈনিক দলকে লেং মুরশেদের নেতৃত্বে পাঠাই যাতে সে তাদের পিছন দিয়ে আক্রমণ করতে পারে। তার আক্রমণও বেশ ফলপ্রসূ হয়। সারাদিন যুদ্ধ করার পর আমাদের গোলাবারুদ প্রায় ফুরিয়ে যায়। এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের এক অংশের সৈনিকদের গোলাবারুদ এবেবারেই ফুরিয়ে যায়। অয়ারলেস যোগাযোগের ব্যবস্থা না থাকায় তাদেরকে গোলাবারুদ পাঠানো সম্ভব হয় নাই, এমনকি তারাও কোন খবর দিতে পারেনি। এখানে একটা বেশ মজার ঘটনা ঘটেছিল। যখন আমাদের সৈনিকদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে যায়, ঐ মুহূর্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যারা ঐদিকে অগ্রসর হচ্ছিল তাদেরও গোলাবারুদ ফুরিয়ে যায়। কারণ আমাদের সৈনিকদের যখন গোলাবারুদ ফুরিয়ে যায় তখন তারা অবস্থান ছেড়ে পিছিয়ে আসে। অনুরূপ পাকবাহিনীও যারা আমাদের বাহিনীর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তারাও গোলাগুলি না করে পিছনের দিকে চলে যায়।

 এই অবস্থান সুরক্ষিত না থাকায় পরমুহূর্তে পাকবাহিনীর কিছু সৈনিক আমাদের ব্যূহের ভিতর ঢুকে পড়ে। এতে আমাদের অবস্থান রক্ষা করা আমাদের জন্যে বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। এখানে রীতিমতো হাতাহাতি যুদ্ধ হয়। অবশেষে আমি তাদের হুকুম দিতে বাধ্য হই কারা যেন পেছনে চলে আসে। এই যুদ্ধে যারা অসীম সাহসের