পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৮০

পরিচয় দিয়েছে তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ ১। ক্যাপ্টেন নাসিম (বর্তমানে লেঃ কর্নেল), ২। ক্যাপ্টেন মতিন (বর্তমানে মেজর) ৩। সুবেদার করিম (বর্তমানে সুবেদার মেজর), ৪। হাবিলদার এরশাদ, ৫। সিপাহী সোলেমান, ৬। সিপাহী মান্নান, ৭। সিপাহী খায়ের (শহীদ)।

 এই যুদ্ধে আমার অনুমান পাকিস্তানী সৈনিক খুব কম হলেও ২৭০ থেকে ৩০০ জন হতাহত হয়েছিল। মাধবপুরের যুদ্ধে সিপাহী খারে এবং সিপাহী শাহজাহান শাহাদত বরণ করেন। তাছাড়া বেশ কিছুসংখ্যক আহত হয়। মাধবপুর থেকে সরিয়ে আমি তাদের সিলেটের মনতলাতে নিয়ে আসি এবং নতুন করে আবার ব্যূহ তৈরী করার নির্দেশ দিই।

 মাধবপুরের যুদ্ধের পর যেসব এলাকা আমার নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল সেগুলো হল, উত্তরে শ্রীমঙ্গল, শায়েস্তাগঞ্জ এবং দক্ষিণে তেলিয়াপাড়া, মুকুন্দপুর, সিঙ্গারবিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকার দিক থেকে শাহবাজপুর এবং মাধবপুরের দিকে আসছিল। তাদের লক্ষ্য চিল যত শীঘ্র হোক সিলেটের সৈন্যদের সাথে যোগাযোগ করা। তাই তারা মরিয়া হয়ে সিলেট হাইওয়ে ও ব্রাহ্মবাড়িয়া-সিলেট হাইওয়ে তাদের নিয়ান্ত্রণে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিল।

 আমাদেরও চেষ্টা ছিল যাতে করে তারা এ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে না পারে। তাই সিঙ্গারবিল থেকে শাহজিবাজার পর্যন্ত এক প্রতিরক্ষাব্যূহ নির্মাণ করি। পাকিস্তানীরা কেবলমাত্র ঢাকা থেকে সৈন্য এনে সিলেটের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিল না, তারা কুমিল্লার দিক থেকেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেটের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে। কুমিল্লার দিক থেকে যে সমস্ত সৈন্য অগ্রসর হচ্ছিল তাদের বাধা দেওয়ার জন্য মেজর খালেদ মোশাররফ কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাইওয়ে এবং কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে লাইনের উপর নিম্মলিখিত জায়গায় পুল ভেঙ্গে দিয়ে সৈন্য মোতায়েন করে, যাতে পাকিস্তানী সৈনিকরা বিনা বাধায় অগ্রসর হতে না পারে। যে সব পুল ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল সেগুলো হলঃ উজানিসার হাইওয়ে ব্রীজ, গঙ্গাসাগর এবং আখাউড়া রেলওয়ে ব্রীজ।

 আমরা নিম্নলিখিত কারণে পাকিস্তানী সৈনিকদের অগ্রগতি রোধ করতে পারছিলাম না: আমাদের সৈন্যসংখ্যা ছিল কম। তাছাড়া আমাদেরকে এই স্বল্পসংখ্যাক সৈন্য নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় প্রতিবক্ষাব্যূহ তৈরী করে পাকিস্তানী সৈনিকদের বাধা দিতে হচ্ছিল। অপরদিকে পাকিস্তানী সৈনিকরা এক জায়গায় কনসেনট্রেট্‌ ছিল এবং তাদের সৈন্যসংখ্যাও বেশী ছিল। ফলে আমাদের পক্ষেও অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে তাদের অগ্রগতিকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। শুধু তাদের সৈন্যসংখ্যাই বেশী ছিল না, তাদের বিপুল পরিমান অস্ত্রশস্ত্রও ছিল। যেহেতু আমরা সিলেট হাইওয়ের উপর তেলিয়াপাড়াতে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরী করে রেখেছিলাম সেহেতু পাকিস্তানী সৈন্যরা ঐ ব্যূহ ভেদ করে অগ্রসর হবার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিল। কারণ সিলেটে অগ্রসর হতে হলে ঐ প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেদ করা একন্ত প্রয়োজন ছিল।

 শেরপুর এবং শাদিপুর আমাদের যে ব্যূহ ছিল সেগুলোর পতন হয় ২৪শে এপ্রিল তারিখে। এই যুদ্ধে পাকিস্তানীরা প্রায় দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্যসিলেটের রি দিক থেকে মোতায়েন করে। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য ছাড়াও তাদের জঙ্গী বিমানও বেপরোয়াভাবে আক্রমণ চালায়। এই যুদ্ধে পাকিস্তানীদের বেশসংখ্যক সৈন্য হতাহত হয়। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল ক্যাপ্টেন আজিজ (বর্তমানে মেজর)। যুদ্ধ চলাকালে ক্যাপ্টেন আজিজ জেট জঙ্গী বিমানের গুলিতে আহত হয়। আমাদের যারা শহীদ হয়েছিলেন, তারা ল্যান্স নায়েক আবদুল হাই, সিপাহী মোহসীন, সিপাহী শাহাদত হোসেন, নায়েক সুরত আলী, সিপাহী রহিসউদ্দিন মোল্লা, মোজাহিদ সুরদন নমসুদ্র।

 শেরপুর-শাদিপুর পতনের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য সিলেটে আমাদের সৈন্যসংখ্যা পর্যাপ্ত ছিল না। তাই তারা অতি সহজে এবং শীঘ্রই সিলেটের দিক থেকে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে।