পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৮২

 তেলিয়াপাড়া ব্যূহ রক্ষা করার জন্য যে ২১ দিন হয়েছিল সেই যুদ্ধে এই সমস্ত অফিসার এবং সৈনিকরা মনোবল ও সাহসিকতার যে পরিচয় দিয়েছেন তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই ২১ দিন লড়াইয়ে মধ্যে পাকবাহিনী তেলিয়াপাড়ার উপর প্রায় দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য দিয়ে পাঁচবার আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে তাঁরা তিনবার আমাদের কাছ থেকে তেলিয়াপাড়া দখন করে। আমরা দুবার তাদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হই। কিন্তু তৃতীয় বারে তাদের সৈন্যসংখ্যা ও অস্ত্রশস্ত্র এত বেশি ছিল যে তেলিয়াপাড়া ঐবার আর দখল করা যায়নি। ১৯ শে মে শেষ পর্যন্ত তেলিয়াপাড়ার পতন হয়। তেলিয়াপাড়ার যুদ্ধে যারা শাহাদত বরণ করেন তারা হলেনঃ সিপাই মোবারক আলী, সিপাই রংগু মিয়া, নায়েক নিজাম উদ্দীন, ল্যান্স নায়েক আসলাম মিয়া, সিপাই আব্দুল গফুর মিয়া, সিপাই আলী আজম ভূঁইয়া, সিপাই জামাল উদ্দীন, সিপাই আবু মিয়া, মোজাহিদ গিয়াস উদ্দীন, মোজাহিদ আলকাস মিয়া।

 এই পর্যায়ে নিম্নলিখিত গেরিলা অপারেশনগুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্যঃ

 মাধবপুর এ্যামবুশ, ১৪মেও মাধবপুরের পতনের পর পাক সেনাবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট সড়ক ব্যবহার করতে শুরু করে। যদিও ঐ সড়কের স্থানে স্থানে আমরা পুল ভেঙ্গে দিয়েছিলাম তবুও তারা বিকল্প পথ তৈরী করে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। তাদের যাতায়াতে বাধা দেবার জন্য মাধবপুরের কাছে ঐ এক বিকল্প সড়কের উপর পাকবাহিনীকে এ্যামবুশ করার জন্য ১৪ই মে তারিখে লেঃ মোরশেদের নেতৃত্বে ১২ জন সৈনিকসহ একটি দল পাঠাই। এ দল ঐ জায়গাতে রাত প্রায় দুটায় পৌঁছে এবং বিকল্প সড়কের উপর দু'খানা ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন পেতে তারই পাশে ওত পেতে বসে তাকে। সারারাত বৃষ্টি হয়েছিল এবং সকাল প্রায় ৮টা পর্যন্ত এ সড়কে পাক সেনাবাহিনীর কোন গাড়ী না চলাতে তাদের এমনিই বসে থাকতে হয়। বৃষ্টিতে তারা সবাই ভিজে যাওয়াতে নিকটবর্তী এক গ্রামে আশ্রয় নেয়। গ্রামে এক নির্জন বাড়ীতে যখন তারা বিশ্রাম নিচ্ছিল তখন সিলেটের দিক থেকে প্রায় এক ব্যাটালিয়ন পাকবাহিনী ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। এই কনভয়ের সবচেয়ে প্রথম গাড়ীটি ছিল একটি জীপ গাড়ী। ঐ জীপ গাড়ীটি বিকল্প পথের দিয়ে যাবার সময় ট্যাংকবিধ্বংসী মাইনের উপর গিয়ে পড়ে এবং সাথে সাথে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এই গাড়ীটি ধ্বংস হবার পর আমাদের সৈনিকরা সেখানে (ঐ বাড়ীতে) নীরবে বসে থাকে এবং অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। প্রথম গাড়ীটি বিধ্বস্ত হবার পর তার পেছনের গাড়ীটি দ্রুত এগুবার চেষ্টা করে। ফলে সেটিও মাইনের উপর গিয়ে পড়ে এবং বিধ্বস্ত হবার সাথে সাথে পাক সৈনিকরা বিপদ দেখে গাড়ী থেকে দ্রুত নেমে পড়ে এবং ঔ পুরো গ্রামখানি ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। আমাদের এ্যামবুশ দলটিতে মোট ১২ জন লোক ছিল। আর শত্রুপক্ষের খুব কম হলেও প্রায় ৪০০ লোক ছিল। আমাদের লোকজন যখন দেখল যে তারা প্রায় ঘেরাও হয়ে যাচ্ছে, তখন তারা শত্রুদের উপর গুলি ছুড়ে ট্যাকটিক্যাল উইথড্র করে আসতে বাধ্য হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের পেছনে প্রায় তিন মাইল পর্যন্ত ধাওয়া করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এখানেই সর্বপ্রথম ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন ব্যবহৃত হয়েছিল। এই এ্যামবুশে দু'খানা যানবাহন একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে যায় এবং ঐসব গাড়ীতে যারা ছিল তাদের অধিকাংশ হতাহত হয়। এই এ্যামবুশে যারা অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ ১। লেঃ মোরশেদ (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) ২। সেলিম (ছাত্র) পরবর্তীকালে লেঃ (শহীদ) ৩। আনিস (বর্তমানে লেফটেনেণ্ট)।

 নালুয়া চা বাগানের এ্যামবুশঃ ১৫/১৬ই মে, ১৯৭১ সন-১৫/১৬ই ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান ১২/১৩ জন সৈনিক নিয়ে নালুয়া চা বাগানে সিলেট সড়কের উপর এক এ্যামবুশ তৈরী করে। ঐ দিন প্রায় এক কোম্পানী পাকসেনা সিলেট থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে যাচ্ছিল। বিকেল প্রায় দুটায় দিকে তারা ঐ এ্যামবুশের ভেতরে চলে আসে এবং চারিদিক থেকে আমাদের সৈনিকরা তাদের উপর গোলাবর্ষণ করতে শুরু করে। ঐ এ্যামবুশে ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন ব্যবহৃত হয়। এ এ্যামবুশ এত কার্যকরী ছিল যে পাকসেনা বাহিনীর এক কোম্পানী সৈনিকের মধ্যে অধিকাংশই নিহত হয়। তিনখানা গাড়ী সম্পূর্নরূপে ধ্বংস হয় এবং দু'খানা গাড়ী বিকল হয়ে যায়। আমাদের সৈন্য সংখ্যা বেশী না থাকাতে সে স্থান ত্যাগ করে পিছে চলে আসতে বাধ্য হয়। পরে চা