পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৮৭

সূত্র থেকে পাওয়া খবর মিলিয়ে দেখলাম একই দিক নির্ণয় করছে। মনে হল আমরা বোধ হয় হব পরবর্তী টার্গেট, এবং এ অবস্থায় নিয়মতান্ত্রিক আনুগত্য নিরর্থক। টঙ্গীর গোলাগুলির আওয়াজ থেমে যাওয়ার পর আমি মেজর শফিউল্লাহ, মেজর মইন, ক্যাপ্টেন আজিজ এবং সবেদার নূরুল হককে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্যে আমার নিজের কামরায় ডেকে পাঠালাম। (এই সঙ্গে জয়দেবপুরের অবস্থান সম্বন্ধে একটু বলা দরকার যাতে সবাই জিনিসটা ভালভাবে বুঝতে পারেন। পুরো ব্যাটালিয়নের অবস্থান ছিল জয়দেবপুরের জমিদার বা রাজবাড়ীতে। প্রকাণ্ড চত্বরের ভিতরে অনেকগুলো বড় বড় দোতলা বিল্ডিং-এর সমষ্টি। বর্তমানে এগুলো মহকুমা প্রশাসক এবং মহকুমা পর্যায়ের বিভিন্ন অফিসের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। দক্ষিণে স্বল্প উঁচু পাঁচিল ও গেট। এই গেট দিয়ে ঢুকলে গোটা দুয়েক বাস্কেট বল/ভলিবল গ্রাউণ্ড সাইজের মাঠ। মাঠের পরেই বড় উঁচু দোতলা পুরানো কালের বিল্ডিং, নীচে অফিসার মেস এবং জুনিয়র অফিসারদের থাকার জায়গা। দোতলা মেসের ড্রয়িংরুম। পুবের দিকে টু-আই-সি এবং অন্য একজন মেজর থাকতেন। পশ্চিমের দিকে কামরা ছিল সিও'র জন্য। এ বিল্ডিং সংলগ্ন পশ্চিম এবং উত্তর কোনা থেকে শুরু করে উত্তর দিকে বিস্তৃত আর একটি বড় দোতলা বিল্ডিং ‘এল’- এর মত দেখতে। ব্যাটালিয়নের সমস্ত অফিস এই বিল্ডিং-এ ছিল। প্রথম বিল্ডিং-এর সঙ্গে দ্বিতীয় বিল্ডিং এর সরাসরি যোগাযোগ ছিল না। নীচে নেমে বাইরে থেকে ঘুরে আসতে হত। ঐ দ্বিতীয় বিল্ডিং-এর উত্তরে আরও একটি বড় দোতলা বিল্ডিং পুবের দিকে বিস্তৃত ছিল। সেটা চিল ট্রপস-এর বসবাসস্থান। পুবের দিকেও দেওয়াল এবং কিছু বিল্ডিং দিয়ে ঘেরা ছিল।) তারা এসে পৌঁছতেই আমি বললাম যে, পরিস্থিতি এখন অসহ্য, আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। আপনাদের মতামত কি? কেউ কোন উত্তর দিলেন না। আমি ধরে নিলাম মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ। আমার মনে চিন্তা খেলে গেল যে আমাদের ক্ষুদ্র এবং বিভক্ত শক্তি নিয়ে ঢাকার দিকে এগিয়ে যাওয়া আত্নহত্যার শামিল, এবং আমাদের প্রয়োজন সমস্ত ব্যাটালিয়নকে এক জায়গায় একত্রীভূত করা এবং সেটা ময়মনসিংহেই সম্ভব। এ ছাড়া জয়দেবপুর রাজবাড়ীর পিছনে কিছু সরকারী কোয়ার্টারে আমাদের কিছুসংখ্যক জেসিও এবং এনসিও এবং সেপাইদের ফ্যামিলি আছে এবং আমার মনে হল যে, আমরা চলে যাওয়ার পর পাক বাহিনীর প্রথম আক্রোশ ঐসব পরিবারবর্গের উপর পরবে। সেইজন্যে আমি সুবেদার নূরুল হককে জিজ্ঞাসা করলাম, “এইসব ফ্যামিলির কি হবে?” তিনি তার উত্তরে বললেন যে, তাদের জন্যে আপনি চিন্তা করবেন না, আমরা তাদেরকে আশেপাশের গ্রামে পাঠিয়ে দেব, এবং সেখানকার পাবলিক তাদের দেখাশুনা করবে। তখন আমি তাকে বললাম যে, পরের দিনের ভিতরেই যেন এ বন্দোস্ত হয়ে যায়। তারপর আমি ক্যাপ্টেন আজিজকে (এ্যাডজুটেণ্ট) গাড়ীর এভাইলিবিলিটি' অর্থাৎ কয়টা জীপ, ডজ, লরী চালু অবস্থায় আছে জানতে চাইলাম। তিনি যে পরিসংখ্যান দিলেন, তাতে আমি আন্দাজ করতে পারলাম মর্টার প্লাটুন এবং কিছু সৈন্য-আন্দাজ এক রাইফেল প্লাটুন (২৫/৩০)নিজেদের হাতিয়ার এবং গোলা-বারুদসহ উঠানো সম্ভব হবে। তখন একটা প্রশ্ন থেকে গেল যে, অবশিষ্ট লোকজন এবং গাজীপুরে যারা আছেন তাদেরকে কি করে নেওয়া যাবে। তখন মেজর মইন স্বেচ্ছাকৃতভাবে বললেন যে, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে তিনি নিজে ‘ক্রস-কাণ্ট্রি' পায়ে হেঁটে গফরগাঁও হয়ে ময়মনসিংহে নিয়ে যাওয়ার নেতৃত্ব দেবেন। তখন আমি প্লান করে ফেললাম, আগামীকাল সকালে এক পার্টি গাড়ীতে টাঙ্গাইলে হয়ে ময়মনসিংহ যাবে এবং বাকীরা আগামীকাল সন্ধ্যায় রওনা হবে। গাড়ীর জন্য চেষ্টা করা হবে এবং যদি সম্ভব না হয় তাহলে পায়ে হেঁটে রওনা হবে। এটা স্থির করার পর, আমি তদানীন্তন মেজর শফিউল্লাহকে এই নির্দেশ দিই, যেহেতু তোমার ফ্যামিলি এখন ঢাকাতে নাই (তারা তখন কুমিল্লাতে তার শ্বশুরালয়ে ছিল), তোমার সমস্যা একটু কম। আগামীকাল সকালে অর্থাৎ ২৮শে মার্চে মর্টার প্লাটুন এবং এক রাইফেল প্লাটুন নিয়ে টাঙ্গাইল রওনা হয়ে যাবে। রাস্তায় যদি কোন রোড ব্লক পাও সেগুলো সাফ করবে। সেখানকার স্থানীয় লোকদের সঙ্গে ‘কনট্যাক্ট’ করে বলে যাবে ঐগুলো খোলা রাখতে এবং রাত্রে আমাদের অবশিষ্ট লোক চলে যাওয়ার পর ঐগুলো বন্ধ করে দিতে। টাঙ্গাইল পৌছে সেখানকার কোম্পানীর দায়িত্বভার বা অধিনায়কত্ব নিয়ে নিবে এবং ঐ কোম্পানী সমেত ময়মনসিংহে একত্রীভূত হবে। আমরা সবাই আগামীকাল, অর্থাৎ ২৮শে মার্চ ৭১, সন্ধ্যার পর এখান থেকে রওনা হব।”