পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৮৮

 মেজর মঈন, ক্যাপ্টেন আজিজ এবং সুবেদার নূরুল হককে স্ব স্ব দায়িত্বের কাজের নির্দেশ দিয়ে দিলাম। তাদের সবাইকে বলা হল যে আমাদের এই প্লানের গোপনীয়তা যেন বজায় থাকে, নেহাৎ প্রয়োজনীয় এবং নূন্যতম লোককে বলবে। কোনক্রমেই যেন অবাঙালীরা (২০/২৫ জন, যারা তখনও আমাদের সঙ্গে ছিল) যেন জানতে না পারে, কারণ যোগপনীয়তাই হবে আমাদের আপাতত কার্যসিদ্ধির একমাত্র পথ। এবং তাদেরকে ধোঁকা দেওয়ার জন্যে আগামীকাল ২৮শে মার্চ সকালে সব ট্রুপসকে একত্রীভূত করবে যেকানে আমি সমস্ত্র পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার জন্যে আমি আমার ‘টু-আই-সি' মেজর শফিউল্লাহকে মর্টার প্লাটুন এবং একটি রাইফেল প্লাটুন দিয়ে সেখানে পাঠাচ্ছি।

 এইসব করার পরে আমার নিজের ফ্যামিলির সম্বন্ধ্যে একটু চিন্তা হল। তারা ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্ট। তাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিল না। চিন্তা করলাম যে কোনরকমভাবে ঢাকাতে গিয়ে তাদেরকে এদিকে নিয়ে আসা বা ছাউনী থেকে সরিয়ে দেওয়া যায় কিনা। সেইজন্যে পরের দিন অর্থাৎ ২৮শে মার্চ স্বল্পক্ষণের জন্যে ঢাকাতে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে এবং টঙ্গী ব্রিজে একটা জীপ রাখতে অণুরোধ করে অয়ারলেস সেটে একটা মেসেজ পাঠালাম। শেষক্ষণ পর্যন্ত আর কোন উত্তর আসে নাই।

 ঐ রাত্রে নতুন আর কোন ঘটনা ঐ অঞ্চলে গটে নাই। অবশ্য দেশের বিশেষ করে ঢাকার ঘটনাবলীর বিভিন্ন বিবরণ বিভিন্ন সূত্রে আমাদের কাছে এসে পৌছাতে থাকায় সৈনিকদের মানসিক উত্তেজনা বেড়ে যাচ্ছিল। বিশেষ করে ঐ দিন আমাদের ব্যাটালিয়নের একটা গাড়ীর ড্রাইভারের (গাড়ীটা কছুিদিন আগে মেরামতের জন্যে ঢাকা ওয়ার্কশপে ছিল, এবং সে ঢাকাতে আটকা পড়েছিল। ২৭ মে মার্চে স্বল্পকালীন কারফিউ বিরতির সময় তাকে ওয়ার্কশপের কেউ হুকুম দেয় গাড়ীটা নিয়ে ইউনিটে চলে যেতে। গাড়ী নিয়ে আসার সময় টঙ্গী ব্রিজের ব্লকের জন্যে আটকে যায় এবং সেখানে আর্মি এ্যাকশন শুরু হয়ে যাওয়াতে গাড়ী ফেলে পায়ে হেঁটে জয়দেবপুরে এসে পৌঁছাই।) আর্মি এ্যাকশনের প্রাথমিক বিবরণে যথেষ্ট প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে থাকে।

 ২৮ শে মার্চ ১৯৭১ঃ পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আমি আনুমানিক সকাল সাড়ে আট বা নয়টার সময় জয়দেবপুরের সমস্ত র‍্যাংকের ট্রুপসকে (বাঙালী, অবাঙালী সব) এক জায়গায় করে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করি, এবং জানাই যে মেজর শফিউল্লাহ সাহেবকে মর্টার এবং একটি রাইফেল প্লাটুন দিয়ে টাঙ্গাইলে অবস্থার উন্নতির জন্যে পাঠাচ্ছি।

 আনুমানিক সকাল ১০ টার দিকে যখন মেজর শফিউল্লাহ প্রায় তৈরী হয়ে গিয়েছেন রওনা হবার জন্যে, আমার মনে হল যে গাড়ীর বনোেদবস্ত্র না হলে রাত্রে সি-ও হিসাবে ট্রুপসের সঙ্গে পায়ে হেঁটে রওনা হতে হবে, এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমার পক্ষে অতিরিক্ত ইউনিফর্ম নেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। তাই মেজর শফিউল্লাহকে ডেকে তার স্যুটকেসে আমার দুই সেট ইউনিফর্ম দিয়ে দিই। ঐ সময় সেঃ লেঃ মোর্শেদ উপস্থিত ছিলেন। ঐ সময় অন্যান্য কাজের ভিতরেও টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহের খবরের জন্যে যথেষ্ট উৎকণ্ঠিত ছিলাম। সকাল থেকেই ময়মনসিংহের সঙ্গে অয়ারলেস যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল।

 প্রায় সাড়ে দশটার দিকে মেজর শফিউল্লাহ তার পার্টি নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন। ওদের যাওয়ার সময় স্থানীয় লোকজন 'জয় বাংলা' ইত্যাদি ধ্বনি দিয়ে তাদের উৎসাহিত করছিল। আমার ধারণ হল যে, আমাদের প্ল্যান স্থানীয় লোকেরা জেনেছে এবং এই অবস্থায় আমাদের ট্রুপস গেলে অবাঙালীরা যারা তখনও আমাদের সঙ্গে আছে, মনে করবে যে, আমাদের টাঙ্গাইল রি-ইনফোর্সমেণ্ট পাঠানো একটা ভাঁওতামাত্র। সেইজন্য সাধারণ পাবলিককে ধমক দিয়ে সরিয়ে দেওয়া এবং ভয় দেখানো একটা নাটকের অভিনয় মত করতে হল। ওদের রওনা হয়ে যাওয়ার কিছু পরে সরকারীভাবে আমি ব্রিগেডে লিখিত মেসেজ পাঠিয়ে দিলাম এই বলে যে, টাঙ্গাইলের অবস্থার উন্নতি সাধনকল্পে আমি মেজর শফিউল্লাহকে উপরোল্লিখিত সৈন্যসহ পাঠিয়েছি। এইজন্য করলাম যে, কোন সন্দেহ যাতে আমাদের উপর না আসে।