পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৯১

কারেণ্ট ছিল না, অতএব ছিল গাঢ় অন্ধকার। (পরে জেনেছিলাম যে, টঙ্গী থেকে আর্মি ইলেকট্রিক কানেকশন অফ করে দিয়েছিল বোধ হয় পরের দিন আমাদের উপর অপারেশন চালানেরা জন্যে, এবং অবশ্য আমরাও লাইন কেটে দিয়েছিলাম।) দিনের ভিতর মেজর মইন, অন্যান্য অফিসার এবং জেসিওরা মিলে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় আমাদের সকলের উঠানোর জন্যে গাড়ী বন্দোবস্ত করে ফেলেছিলেন। যাই হোক, রাত্রি আটটার সময় প্রয়োজনীয় লোকদেরকে আমার অফিসে একত্রিভূত করি-মিলিটারী ভাষায় যাকে বলে “ও’ গ্রুপ। আমি রাত ৮-৩০ মিঃ সময় নির্দেশ করি অর্থাৎ ঐ সময় থেকে আমাদের ‘মুভ’-এর কার্যাবলী শুরু হবে। কিন্তু ঐ সময় আমাদের কোন একজন বলে উঠলেন সময়টা একটু পিছিয়ে দিতে, কেননা তার উপর যে একটা দায়িত্ব অর্পিত ছিল তার প্রস্তুতির জন্যে আর একটু সময়ের প্রয়োজন। আমি তখন রাত ৮টা ৪৫ মিঃ সময় নির্ধারণ করে দিলাম।

 এর আগে ক্যাপ্টেন আজিজকে একটা নির্দেশ দেওয়া ছিল যে, আমি আমাদের ‘মুভ’-এর অর্থাৎ যাত্রা শুরুর সময় দেওয়ার পর পরই তিনি এক সেকশন (দুটি) মেশিনগান এবং এক সেকশন (দুটি) রিকয়েললেস এ্যাণ্টি- ট্যাংক গান নিয়ে জয়দেবপুরের চৌরাস্তায় গিয়ে টঙ্গীর দিকে তাক রেখে রোড ব্লক সৃষ্টি করেন, যাতে আমাদের মুভের সময় টঙ্গীর দিক থেকে পাক আর্মি কোন গণ্ডগোল করতে না পারে এবং বাধা পায়। আমার ‘অর্ডার' শেষ হওয়ার পর ক্যাপ্টেন আজিজ আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে তার নিজের কাজে চলে গেলেন।

 বলাবাহুল্য যে, ঐ সময় পর্যন্ত দুপুরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময়কার প্রাইভেট জামাকাপড় পরিহিত অবস্থায় ছিলাম। অর্ডার শেষ কারার পর নীচের মেসে এসে দেখি যে, অবাঙালী দু'জন অফিসার- ক্যাপ্টেন রিয়াজ এবং নকভী খাওয়ার টেবিলে বসে রাত্রের খাবার খাচ্ছেন। আমিও তাদের সঙ্গে বসে রাত্রের খাবার খেলাম এবং তাদেরকে কিছু কথাবার্তায় ব্যস্ত রাখলাম। বুঝলাম যে, আমাদের প্ল্যান সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত এবং আমাকে সিভিল কাপড়ে দেখে উৎকণ্ঠ। যদিও কিছু হয়েও থাকে-সরে গেল।

 ৮টা ৪০ মিঃ কি ৮টা ৪২ মিঃ-এর দিকে আমি উপরে নিজের কামরায় উঠে গেলাম পেশাক পরে তৈরি হবার জন্যে। উপরে অন্ধকার ছিল। নীচে মেসের গ্যাসের আলো থেকে উপরে উঠে অন্ধকারটা আরও বেশী লাগছিল। আমি মনে করলাম যে, একটু অপেক্ষা করি। কেননা একটু পরেই ‘এ্যাকশন' শুরু হবে এবং অবাঙালীদের নিরস্ত্র বা কিছু করার পর আমার কাছে কেউ নিশ্চয় আসবে। তখন আমি তৈরী হয়ে নেব। আমাদের প্লান ছিল যে সঙ্গেকার পাকিস্তানীদেরকে নিরস্ত্র কবর, এবং যদি তারা বাধা দেয় তখন গুলি চালাতে হবে, তবে গুলি চালানো হবে যথাসম্ভব স্বল্প এবং ক্ষিপ্ত-ভবিষ্যতের জন্য গোলাগুলি বাঁচাতে হবে।

 নির্দিষ্ট সময়ে বা ঐ সময়ের ৫-১০ সেকেণ্ড আগে নীচে গুলি বিনিময় শুরু হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে এবং প্রচণ্ডতা বেশ বেড়ে গেল। আমি তখন উপরের তলায় একটু একটু সতর্ক হয়ে উঠলাম। আমার কাছে তখন কোন হাতিয়ার ছিল না। অল্প কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারলাম যে কোন লোক সন্ত্রস্ত্রভাবে অথচ তাড়াতাড়ি পা টিপে সিঁড়ি বেয়ে উপরের তলায় উঠে আসল। আমি একটু আশান্বিত হলাম আমাদের কেউ হবে। কিন্তু সিঁড়ি শেষ হওয়ায় তার পায়ের আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। সংশয় বেড়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে আওয়ার পেলাম আর একজন লোকের জোর কদমে উপরে উঠে আসার। শেষোক্ত লোকটা যখন মাঝসিঁড়িতে তখন প্রথমোক্ত লোকটা তার উপর টর্চলাইটের আলো ফেলে। নীচের লোকটি তখন জিজ্ঞোস করে ওঠে “কৌন হ্যায়”। উপরের লোকটি বলে, “আমি ক্যাপ্টেন নকভী, কেন?” নীচের লোকটি বলে ওঠে, ঞা, নকভী বেঁচে, তারপরই সে সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নীচে নেমে গেল। আমি অনুভব করলাম যে, আগের লোকটা, অর্থাৎ যে উপরের তলাল রয়ে গিয়েছে, সে হল ক্যাপ্টেন নকভী-অবাঙালী এবং সশস্ত্র। এত কিছু করার পরেও নিজের জন্যে ভরাডুবি। পরিণতি কি আল্লাহ জানে। হঠাৎ খেয়াল হল, এমনিও শেষ, ওমনিও শেষ, ঘটনা অজানার একটু ভান করে দেখা যাক না। একটু সতর্ক থেকে, পিলারের আড়াল থেকে নকভীর সঙ্গে কথা বলে জিজ্ঞাসা করলাম “ব্যাপার কি, নীচে গোলাগুলি চলছে কেন?” সে বলল, “জানি না স্যার, ওরা আমাদের উপর গুলি করছে, দেখেন আপনি টেলিফোনে