পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৯৩

মার্চের উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে লিখেছেনঃ ঐদিন বিকালে কিছু অফিসার, জেসিওদেও সঙ্গে কথা বলার সময়- বিশেষ করে সুবেদার নূরুল হক সংশয় প্রকাশ করেন যে, আমাদের ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করতে পারে। আমি এ ব্যাপরে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি এবং ঐদিনই সন্ধায় অতর্কিত হামলার মোকাবেলার মত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অর্থাৎ অবস্থান সুদৃঢ় করা, অধিকসংখ্যক প্রহরী নিযোগ ইত্যাদি বন্দোবস্ত করি।

 রকীব সাহেবের এই বক্তব্যে অবাক না হয়ে পারছি না, কারণ তার এই মন্তব্য আমাদেও অদূরদর্শিতা ও সমরপ্রস্তুতির শৈথিল্যেরও ইঙ্গিত বহন করে বলে আমার মনে হয়। এই ব্যাটালিয়নকে যে নিরস্ত্র করার চেষ্টা হতে পারে তা জয়দেবপুর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাবাসীদেও আলোচনা ও উদ্বেগের বিষয় ছিল।তাই ১৭ মার্চ এলাকাবাসীরা জয়দেবপুর থেকে টঙ্গির রাস্তার উপর ৩০ থেকে ৪০টিরও বেশী ব্যরিকেড তৈরি করে রেখেছিল।যেখানে ঐ এলাকার জনসাধারণ আমাদের নিরস্ত্র করা হবে ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে তাদের প্রস্তুতি হিসেবে ব্যারিকেড তৈরি করেছিল সেখানে আমরা কোন বিশেষ প্রস্তুতি ছাড়া ২৬ মার্চ বিকাল পর্যন্ত নীরব, নিশ্চেষ্ট ছিলাম এটা তিনি কিভাবে চিন্তা করতে পারলেন।

 জয়দেবপুরের জনগন এর ব্যাটালিয়ন সমরপ্রস্তুতির কথা কখনও ভুলবে না। এমন কি রকীব সাহেবের ও ভোলার কথা নয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে তিনি ২৬ মার্চ বিকেলেই প্রথম শুনতে পান যে এই ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা হতে পারে আর তাই তিনি ঐদিনই তা প্রতিহত করার সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহন করেন।

 রকীব সাহেবের অবগতির জন্য লিখছি যে, ১৯ মার্চ ১৯৭১ শুক্রবার বিগ্রেডিয়ার জাহানজেব আরবার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সজ্জিত ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে এই ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করার অভিপ্রায় ঢাকা থেকে জয়দেবপুর এসেছেলিন। সেদিন যদি এই ব্যটালিয়ন সমরপ্রস্তুতিতে কোন ত্রুটি বা শৈথিল্য থাকত তা হলে ঐদিনই এই ব্যাটালিয়ন নিরস্ত্র করা হত। সেদিন বিগ্রেডিয়ার জাহানবেজ আরবাব রাজবাড়ীতে ঢুকেই ব্যাটালিনের সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি দেখে আমাদেরও নিরস্ত্র করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকে। লেঃ কর্নেল মাসুদুল হাসান (তৎকালীন ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার) বস্তুতঃ সেদিনই তার ব্যাটালিয়নের কমাও হারিয়েছিলেন।

 ২৭ মার্চ উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে লেখক এক জায়গায় লিখেছেন, টঙ্গীর গোলাগুলি আওয়াজ থেমে যাওয়ার পর আমি মেজর শফিউল্লাহ, মেজর মইন, ক্যাপ্টেন আজিজ ও সুবেদার নূরুল হককে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্য আমার নিজের কামরায় ডেকে পাঠালাম। তারা এসে পৌঁছাতেই আমি বললাম যে পরিস্থিত এখন অসহ্য, আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। আপনাদের মতামত কি? কেউ উত্তর দিলেন না। আমি ধরে নিলাম মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ।'

 রকীব সাহেবের নিবন্ধের এইটুকুই সবছেয়ে বড় অসত্য উদ্ধৃতি। সঠিক কথা হল সন্ধ্যায় আমি তাকে প্রথমবার সরাসরি বলি যে আমাদের আর জয়দেবপুর থাকা উচিত নয়। তাকে আরও বলি যে ব্যাটালিয়কে ময়মনসিংহে একত্রিত করার সমস্ত পরিকল্পনা করে ফেলেছি। আপনিও আমাদের সঙ্গে চলুন। আমার কথায় তাকে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হতে দেখি। যদিও এটা উদ্বিগ্ন হওয়ার মত কথাই ছিল, কারণ আমরা যা করতে যাচ্ছি তা সহজ ভাষায় হচ্ছে বিদ্রোহ এবং তার পরিণতি কি হতে পারে তাও কোন সৈনিকের অজানা থাকার কথা নয়।

 ২৫শে মার্চ বিকালে যখন তিনি এই ব্যাটালিয়নের কর্তৃত্বভার গ্রহন করেন তখন থেকেই আমি তার সঙ্গে সঙ্গে ছিলাম এবং ব্যাটালিয়নের বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি সম্পর্কে অর্থাৎ ব্যাটালিয়নের সৈনিকরা যে পাকিস্থানী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াঁবার জন্য সম্পূর্নভাবে মানসিক ও সামরিকভাবে তৈরি আছে তা তাকে আভাসে ও ইঙ্গিতে বোঝোতে চেষ্টা করেছি।