পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২০২

 রাত প্রায় ১০ ঘটিকার সময় আমার ওস্তাদ লোকাস কুইয়া (খ্রীষ্টান) আমাদের ৭নং প্লাটুনকে উদ্দেশ্য করে যার যার সেণ্ট্রি ডিউটি আছে তাদেরকে দাঁড়াবার জন্য বলে। কিন্তু কেউ ডিউটিতে দাঁড়ালেন না। তখন আমি লোকাস কুইয়াকে বললাম আজ রাতে আমি ও নান্নু ডিউটি করব হালকা মেশিনগান নিয়ে। আমি আর নান্নু দুইজন দুই দরজায় ডিউটির জন্য দুইটা হলকা মেশিনগান নিয়ে দাঁড়ালাম। তর কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানী হাবিলদার সিকিউরিটি নজির বাদশাহ এবং এম,টি, প্লাটুনের হাবিলদার গোলাম হায়দার (পাকিস্তানী) দুইটা চীনা স্টেনগান নিয়ে আমার প্লাটুন হাবিলদার আজিমকে গোপনে কি যেন নির্দেশ দিয়ে যায়।

 আমাদের ব্যারাকের সামনে পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের ১৪ নং ডিভিশনের (যারা ইলেকশন ডিউটিতে ময়মনসিংহ এসেছিল) এক প্লাটুন সৈন্য তাঁবুর মধ্যে ছিল। রাত প্রায় সাড়ে বারটার সময় হটাৎ একটা গুলির আওয়াজ শোনা গেল। তখন লাইনের ভেতরে যে কয়েকজন অবাঙ্গালী ইপিআর ছিল তাদেরকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। নান্নু তখন সাথে সাথে তার হালকা মেশিনগান দিয়ে বারান্দা থেকে পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের প্লাটুনের উপর ফায়ার আরম্ভ করে দেয়। বিহারী সিপাহী মমতাজের নিকট থেকে আমি একটি হালকা মেশিনগান উদ্ধার করি। এই গান বাঙ্গালী সিপাহী (১৫২৭৯) হারুনকে দিই। হারুনকে পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের প্লাটুনের উপর ফায়ার করার জন্য নির্দেশ দিই। সিপাই মোস্তফা (১২৫২৭)-কে একটি হালকা মেশিনগান দিই দোতলা-তেতলা থেকে সিড়ির পথ বন্ধ করার জন্য। তখন আমি উপরতলায় যত বাঙ্গালী ইপিআর ছিল সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম, রাত্রি বেলায় বাঙ্গালী হোক বা অবাঙ্গালী হোক কেউ যেন নীচে নামার চেষ্টা না। করে। যদি কেউ চেষ্টা করে তাকে গুলি করা হবে। তারপর পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের প্লাটুনের সাথে আমাদের সারারাত গুলি বিনিময় হয়। ভোর পর্যন্ত (২৮ শে মার্চ) পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের সমস্ত প্লাটুনকে ধ্বংস করা হয়।

 ২৮ মার্চ সকালবেলা আমি হারুনকে নির্দেশ দিলাম মেগাফোন দিয়ে শ্লোগান দেয়ার জন্যঃ নারায়ে তকবির-আল্লাহু আকবর, জয় বাঙ্গালীর জয়। আরো বললাম সবাই এখন উপরতলা থেকে নিচে নামতে পারে।

 তারপর আমি সিপাই নান্নু, সিপাই মোস্তফা, সিপাই হারুন এবং আরো কয়েকজন সিপাই নিয়ে সুবেদার মেজর জিন্নাত গুলের কোয়ার্টার আক্রমণ করি। সেই কোয়ার্টারে দু'জন হাবিলদারসহ চারজন পাকিস্তানী জেসিও ছিল। আমরা বাঙ্গালীরা সবাই মিলে তাদের উপর ফায়ার করছিলাম। এমন সময় উইং কমাণ্ডার তার পার্টি নিয়ে পেছন দিক থেকে আমাদের উপর আক্রমণ করতে চেষ্টা করে। কিন্তু আমরা দেখে ফেলি। উইং কমাণ্ডার-এর পার্টির সাথে আমাদের গুলি বিনিময় হয়। তার পরই উইং কমাণ্ডার তার পার্টিসহ মুক্তাগাছার দিকে পালাতে চেষ্টা করে।

 ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইলের বাস রোড রেল লাইনের ক্রসিংয়ে উইং কমাণ্ডারের পার্টি পজিশন নেয়। তখন সিপাই নান্নু মিয়া ক্রলিং করে ক্যাপ্টেন কমর আব্বাসের নিকট চলে যায়। কমর আব্বাস নান্নুকে দেখে ফেলে এবং চীনা স্টেনগান নিয়ে নান্নুর উপর ব্রাশ ফায়ার করে। নান্নু পজিশন নেয়াতে তার গায়ে গুলি লাগে নাই। ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস আবার অন্য ম্যাগাজিন গানের মধ্যে লাগাবার চেষ্টা করে। তার আগেই নান্নু ক্যাপ্টেন কমর আব্বাসকে গুলি করে মেরে ফেলে। এইভাবে তার সাথের সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। তার সাথে সাথেই চারদিক থেকে জনতা এসে তাদের মৃতদেহ নিয়ে যায় এবং মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে প্রদর্শন করে ঘুরে বেড়ায়। তারপর আমরা আবার সুবেদার মেজরের পার্টিকে আক্রমণ করি। ২৮শে মার্চ বিকেল পাঁচটার সময় তারা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তারপর আমরা বাঙ্গালী ইপিআররা সুবেদার মেজরের পার্টিকে ময়মনসিংহ জেলে পাঠাই।

 এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সি-কোম্পানী (২য় বেঙ্গল) অধিনায়ক মেজর নূরুল ইসলাম ও লেফটেন্যাণ্ট মান্নান রাত্রিবেলায় ব্রহ্মপুত্র নদের কিনারে সিএগুবি'র ডাকবাংলোতে ছিলেন। যখন গোলাগুলি আরম্ভ হয় তখন আমাদের উইং কমাণ্ডার কমর আব্বাসের পার্টি মেজর নূরুল ইসলামের উপর ফায়ার