পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২০৫

তুলে নেওয়ার জন্যে পর্যন্ত পীড়াপীড়ি করেছিল। মনতলা পতনের শেষ দিন সন্ধ্যায় শত্রুবাহিনী এক ব্রিগেড এবং এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে মেজর নাসিম, লেফটেন্যাণ্ট মোর্শেদ এবং আমার পজিশনের উপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালাল। আমি সে সময়ে ছিলাম আমার কোম্পানী হেডকোয়ার্টারে। আমি যাচ্ছিলাম মনতলা রেলওয়ে লাইনের ডান পার্শ্বে যে দুটো সেকশন ছিল সেগুলো চেক করার জন্যে। পথে জনৈক বে-সামরিক ব্যক্তির কাছে জানতে পারলাম মনতলা রেলওয়ে স্টেশনে আমাদের কোন লোক নেই। তার কথা আমার বিশ্বাস হল না, বরং পাল্টা তার প্রতি আমার বিশেষ সন্দেহের উদ্রেক হল। আমি ঐ লোকটির সঙ্গে আমার দু'জন দেহরক্ষীকে দিয়ে মনন্তলার পজিশন চেক করার জন্য পাঠিয়ে দিলাম। ওদিকে শত্রুবাহিনী ছয়টি কামানের সাহায্যে আমাদের অবস্থানের উপর অনবরত গোলাবর্ষণ শুরু করে দিয়েছে। আমার পাঠানো দেহরক্ষী দু'জন ফিরে এসে জানালো, সত্যি সত্যিই ঐ পজিশনে আমাদের কোন লোক নেই। রাত তখন ৮টা বাজে।

 সেদিনকার ঘটনার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণী দিচ্ছিঃ মেজর নাসিমের অবস্থানের উপর শত্রবাহিনীর প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য আক্রমণ চালায়। এক ব্যাটালিয়নের সৈন্যসংখ্যা প্রায় ৮০০ শত। এই বিপুল সৈন্যের আক্রমণের মুখে মেজর নাসিম ও তাঁর সৈন্যদের অবস্থানে থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তিনি তাঁর কোম্পানী নিয়ে অবস্থান ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। মেজর নাসিম মেজর মঈনের কোম্পানীকে (পরে লেফটেন্যাণ্ট মোর্শেদের দ্বারা পরিচালিত) ফরোয়ার্ড লাইনে টেলিফোনের মাধ্যমে এই সৈন্য উঠিয়ে নেওয়ার সংবাদ জানান। আমার সাথে মেজর নাসিম এবং লেফ্টেন্যাণ্ট মোর্শেদ উভয়ের সাথেই কোন টেলিফোনে যোগাযোগ ছিল না। বাধ্য হয়ে মেজর নাসিম দুজন জওয়ান মারফত আমাকে এই সংবাদ পাঠান যে, শত্রুবাহিনীর আক্রমণ মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। খবরে আরো বললেন যে, শত্রুত্রিমুখী আক্রমণ চালিয়েছে। মেজর নাসিম এবং লেফটেন্যাণ্ট মোর্শেদের সৈন্যদের পজিশন ছিল আমার উভয় পার্শ্বে। তাদের পজিশনে শত্রু প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছিল। মেজর নাসিমের সৈন্যরা তুমূল লড়াই করে শত্রুর অগ্রগতিকে ব্যাহত কারার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করলেন। অবশেষে মেজর নাসিম নিজের ট্রপস এবং আমার কোম্পানীর ২১ জন লোক ও সুবেদার মান্নানকে নিয়ে পঞ্চবটিতে অর্থাৎ কয়েক মাইল পেছনে সরে গেলেন। ওদিকে লেফটেন্যাণ্ট মোর্শেদও প্রাণপণ লড়াই করার পর তাঁর সৈন্যদের নিয়ে সরে পড়তে শুরু করেছেন। আমি এসবের কোন খবরই পাইনি। তদুপরি আমার প্রতিরক্ষা লাইন ছিল কোম্পানী হেডকোয়ার্টার থেকে আড়াই মাইল আগে।

 আমার সে সময়কার মনের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। আমি তখন বলতে গেলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছি। রাত দশটার দিকে আমার হেডকোয়ার্টারের উপর প্রায় দশটা কামানের গোলা এসে পড়ল। আমাদের সংগ্রামী সৈনিকরা অনেকেই একেবারে নতুন। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্যে তারা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের অনেকেই জীবনে এই প্রথম কামানের গোলার আওয়াজ শুনলো। শত্রুডান দিক দিয়ে আমাদের উপর প্রচণ্ড চাপ দিয়ে যাচ্ছে। অধিকন্তু ফরোয়ার্ড ডিফেন্স লাইনে যারা ছিল তাদের উপর প্রচণ্ড চাপ এল। আমি হেডকোয়ার্টারে থেকে কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। ফলে ফরোয়ার্ড ডিফেন্স লাইনে অর্থাৎ ইখতেয়ারপুর ও গিলাতলীতে যারা ছিল তাদের খবরও জানা সম্ভব হল না। কাসিমপুর রেলওয়ে স্টেশনের ওখানে আমার একটি অবস্থান ছিল। সেখানকার জেয়ানদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫ জন। আমি তাদের ওখানে দু'জন রানার পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু শত্রুদের কামান থেকে তখন এমন অবিরামভাবে গোলা বর্ষিত হচ্ছিল যে কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর তারা থেমে যেতে বাধ্য হল।

 রাত তখন দশটা বাজে। আমিও অবস্থান ত্যাগ করাই মনস্থ করলাম। সব জায়গায় লোক পাঠিয়ে তাদের জানিয়ে দিলাম, পরবর্তী অবস্থান এবং প্রতিরক্ষাব্যূহ রচিত হবে চৌমুহনীতে।

 শত্রু তখন তিন দিক থেকে আমাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। আমি হেডকোয়ার্টার নিয়ে চৌমুহনীর দিকে রওনা হলাম। আমরা সবাই নিজ নজি অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ সঙ্গে নিলাম। বাধ্য হয়ে আমরা সে সময়ে অনেক বেসামরিক লোককেও আমাদের অস্ত্রে বোঝা বহন কারার জন্যে সঙ্গে নিয়েছিলাম।