পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২১৯

 ময়মনসিংহ শহর তথা ময়মনসিংহ জেলা তখনও মুক্ত অঞ্চল। কিন্তু তার উপর রাহুগ্রাসের ভয়াল ছায়া নেমে আসছে। দুর্দিন আসন্ন। হামলাকরী পাক-বাহিনী টাঙ্গাইল শহর হস্তগত করে ময়মনসিংহ শহর দখল করবার জন্য দ্রুতবেগে ছুটে আসছে। তাদের এই অভিসন্ধিকে ব্যর্থ করতে হলে পথের মাঝখানেই তাদের প্রতিরোধ করতে হবে। এই প্রতিরোধের ঘাঁটি গড়ে তোলার পক্ষে মধুপুর গড়ই সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। মুক্তিবাহিনী স্থির করেছিল এইখানেই তাদের পথ রোধ করে দাঁড়তে হবে। কিন্তু প্রতিরোধ করবে কারা? প্রতিরোধের মূল শক্তি ইপিআর-এর যোদ্ধারা এক গুরুত্বপূর্ণ কাজে অন্য সেক্টরে চলে গেছে। তারা আসতে আসতে এই দুশমনরা মধুপুর গড় ছাড়িয়ে চলে যাবে। অতএব অবিলম্বে তাদের বাধা দেওয়া দরকার। এই অল্প সময়ের মধ্যেই যেটুকু শক্তি আছে তাই নিয়ে তাদের প্রতিরোধ দিতে হবে।

 মুক্তিবাহিনীর সংগঠকরা বিভিন্ন অঞ্চলের ছাত্রদের কাছে জরুরী ডাক পাঠালেন। সেই আহবানে সাড়া দিয়ে নান জায়গা থেকে ২২ জন ছাত্র মধুপুর গড়ে এসে পৌঁছল। এরা যুদ্ধ করবার জন্য তৈরী হয়ে এল বটে, কিন্তু এদের মধ্যে কেউ আগে থেকে অস্ত্র চালনায় অভ্যস্ত ছিল না। মাত্র দিনসাতেক আগে থেকে তারা ইপিআর-এর লোক বা প্রাক্তন সৈন্যদের কাছ থেকে রাইফেল চালনা শিখছিল। এইটুকু শিক্ষাই ছিল তাদের সম্ভল। আর সম্ভল ছিল অনির্বাণ দেশপ্রেম ও দুর্জয় সাহস। একথা শুনলে কি কেউ বিশ্বাস করতে পারবে যে মাত্র ২২ জন অস্ত্র চালনায় অনভ্যস্ত ছাত্র সেদিন সেই দুর্ধর্ষ পাক-বাহিনীকে মোকাবিলা করতে দাঁড়িয়েছিল? একথা সত্য সত্যই বিশ্বাস করা কঠিন। তাহলেও এটাই ছিল বাস্তব ঘটনা।

 ১৩ই এপ্রিল তারিখে প্রথম সংঘর্ষ ঘটল। দ'পক্ষের মধ্যে গুলিবর্ষণ চলল। ২২টি রাইফেল শত্রুপক্ষের মেশিনগানের জবাব চলেছে। ছাত্ররা বনের আড়ালে আত্মগোপন করে যুদ্ধ করছিল। শত্রুপক্ষের প্রবল গুলিবর্ষণ সত্বেও তাদের মধ্যে একজনও নিহত বা আহত হয়নি। পরে জানা গিয়েছিল, এই দিনের যুদ্ধে ছাত্রদের গুলিতে প্রতিপক্ষের একজন ট্রাক-ড্রাইভার ও একজন জীপ ড্রাইভার মারা গিয়েছিল। বেশ কিছুটা দূর থেকে গুলি বিনিময় চলছিল। এইভাবে বাধা পেয়ে পাক-সৈন্যরা অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাদের অগ্রগতি সেদিনের মত স্থগিত হয়ে গেল। প্রতিরোধকারীদের পক্ষে এটা একটা বিরাট সাফল্য। মাত্র ২২ জন ছাত্রের এই বাহিনী শক্তিশালী শত্রুদের হাত থেকে এই সাফল্যকে ছিনিয়ে নিয়ে এল। এসব ক্ষেত্রে প্রতিটি দিন, প্রতিটি ঘণ্টা অত্যন্ত মূল্যবান। পরদিন ১৪ই এপ্রিল তারিখে এখান থেকে জরুরী ডাক দুই ট্রাকবোঝাই ৫০/৬০ জন মুক্তিদ্ধো ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছে গেল। এদের মধ্যে অস্ত্র চালনায় শিক্ষিত ও অভ্যস্ত যোদ্ধারা ছিল। তাদের সঙ্গে রাইফেল ও হালকা মেশিনগানও ছিল। এদের পেয়ে এখানকার প্রতিরোধ বাহিনী এবার এক শক্তিশালী বাহিনী হয়ে দাঁড়াল।

 ১৪ই এপ্রিল সারাদিন ধরে দু'পক্ষের পচণ্ড যুদ্ধ চলল। শেষ পর্যন্ত এদের প্রতি-আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে সুশিক্ষিত ও আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত পাক-সৈন্যরা প্রাণ বাঁচাবার জন্য ঊর্ধ্বশ্বাসে পেছন দিকে ছুটল। ছুটতে ছুটতে তারা পেছনে ফেলে আসা কালিহাতী, ঘাটাইল অঞ্চলে গিয়ে থামল। প্রতিরোধকারী মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রসর হয়ে পাক-সৈন্যদের পরিত্যক্ত ঘাঁটিতে গিয়ে দেখল যে, সেখানে শত্রুপক্ষের সৈন্যদের মৃতদেহগুলি ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ে আছে। শত্রুরা প্রাণভয়ে পালাবার সময় কতকগুলি শস্ত্রশস্ত্র ফেলেই চলে গেছে। ফলে তাদের পরিত্যক্ত একটি ট্রাক, একটি জীব, ৪০টি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ১৫০ বাক্স মেশিনগানের, গুলি, কতকগুলি মর্টার শেল এবং কয়েক গ্যালন তেল মুক্তিবাহিনীর হাতে এসে গেল।

 মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে এভাবে তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসে পাক-সৈন্যদলের পরিচালকরা নতুনভাবে চিন্তা করতে লাগল। তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। প্রতিপক্ষ তাদের চোখের আড়ালে। আক্রমণের প্রবলতা দেখে তারা মনে করেছিল এক বিরাট সৈন্যদল তাদের পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, কিন্তু কার্যত মুক্তিযোদ্ধাদের মোট সংখ্যা ১০০ জনও হবে না।