পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৩৫

জনসাধারণ ঘরে বসেই দরজা বাংরাদেশেরজানারা দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে। ব্যাপারটা কেমন যেন ঘোলাটে মনে হল। ডি-সিকে টেলিফোন করে জেনে নিতে চাইলাম ব্যাপার কি? কিন্তু টেলিফোন উঠিয়ে এটার কোন সাড়াই পেলাম না। বুঝতে পারলাম লাইন কেটে দিয়েছে। পিছনে চেয়ে দেখলাম সামরিক বাহিনী সার্কিট হাউসের ঠিক পিছনেই তথা জিলা স্কুলে করেছে তাদের সদর দপ্তর। কি করব বুঝতেই পারলাম না। এই বিভ্রান্তিকর অবস্থাতেই কেটে গেল তিন ঘণ্টা। রেডিও লাগান ছিল, ঢাকা বেতারের নিয়মিত প্রোগ্রামটা শুনে যাচ্ছিলাম। তা থেকে শুভাশুভ কিছুই বুঝতে পারলাম না। সাড়ে ৮টা কি ৯টার দিকে হঠাৎ ঘোষণা করা হল নতুন নতুন ‘মার্শাল ল’ আইন। লুফে নিল আমাদের ব্যক্তি ও বাক স্বাধীনতা। বুঝতে পারলাম, বোধ হয় এসেছে আমাদের সেই চরম ও পরম পরীক্ষার দিন। আর এক মুহূর্তও কুষ্টিয়ায় থাকা সমীচীন মনে করলাম না। জীপের পেছনে আবার গাড়ীটাকে বেঁধে এবার উল্টাদিকে অর্থাৎ ঝিনাইদহের দিকে যথাসম্ভব তীব্র গাড়ী চালিয়ে দিলাম। ভাগ্য ভাল কুষ্টিয়ার সার্কিট হাউস ছিল শহরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত। কাজেই কুষ্টিয়া শহরের সীমা অতিক্রম করতে আমাদের এক মিনিটের বেশী সময় লাগেনি। দূর থেকে ইপিআর-এর পোশাক পরা অবস্থায় আমাদের দেখেও আমাদের কিছুই ওরা বলেনি। কেন বলেনি সেটা পরে যতবার ভেবেছি, ততবারই ওদের বোকামি ছাড়া আর কিছুই মনে করতে পারিনি। তবে আমি মনে করি এটা বোধ হয় আল্লাহরই মহিমা। বেলা ১১টায় ঝিনাইদহ পৌঁছে দেখি শহর লোকে লোকারণ্য। আমার জীপকে আসতে দেখে তারা রাস্তা ছেড়ে দিল।

 এখানে একটু বলে রাখা ভাল যে, চুয়াডাঙ্গার ইপিআর-এর ৪র্থ উইং-এর ইতিহাসে আমি ছিলাম প্রথম বাঙ্গালী কমাণ্ডার। আমার বা আমার পরিবারের কারও গায়ের রং দেশে স্থানীয় লোক বিশ্বাসই করতে পারেনি যে আমরা বাঙ্গালী। তাছাড়া এই স্বল্প সময়ে জনসাধারণের সাথে পরিচয় করাও সম্ভব হয়নি। স্থানীয় লোকজনের সাথে পরিচয় করার ওটাই একটা সুবর্ণ সুযোগ মনে করে আমি গাড়ি থেকে নেমে বাংলা ভাষায় লোকজনকে ডাকলাম। লোকজন সবাই দৌড়ে আসল। পরিচয় পেয়ে উৎসাহিত হল। আমার আহ্বানে সমস্ত সহযোগিতার আশ্বাস দিল। আমি তাদেরকে প্রস্তুত থাকবার উপদেশ দিয়ে সেখান থেকে চুয়াডাঙ্গা অভিমুখে রওনা দিলাম।

 আনুমানিক বেলা ১টায় চুয়াডাঙ্গা আমার সদর দপ্তরের সামনের রাস্তায় পৌঁছলাম। আমার গাড়ী দাঁড়াবার সাথে সাথেই আমার বাঙ্গালী উইং হাবিলদার মেজর মজিবর রহমান এসে অভিবাদন করে ঢাকার ঘটনার আনুপূর্বিক বিবরণ দিল। আরও জানাল যে, ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরীর কোনরকম নির্দেশ ছাড়াই উইং হেডকোয়ার্টারের সমস্ত অবাঙ্গালী সেনাদের সে আটক করে রেখেছে এবং অস্ত্রাগার থেকে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র সরিয়ে নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে রেখেছে।

 হাবিলদার মেজর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা দুরভিসন্ধির খবরও আমাকে জানাল। সেটা হল যে ২৫শে মার্চ বিকেল বেলা হঠাৎ করে যশোর থেকে তৎকালীন ইপিআর সেক্টরের উপ-অধিনায়ক অবাঙ্গালী মেজর সরদার আবদুল কাদের চুয়াডাঙ্গা এসেছিল যশোরে একটা অত্যন্ত জরুরী মিটিং-এর অজুহাতে আমাকে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু যখন শুনল আমি চুয়াডাঙ্গায় নেই তখন সে ক্যাপ্টেন সাদেকের বাসায় রাত্রি যাপন করে ২৬শে মার্চ ভোর ৪টার সময় ক্যাপ্টেন সাদেক ও তার পরিবারবর্গকে নিয়ে যশোরে পালিয়ে যায়।

 যাই হোক, হাবিলদার মেজরের কাছ থেকে আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা জানতে পেরে আমি মনে মনে একটা সিদ্ধান্তে প্রায় পৌঁছতে পারলাম। তবুও তাদেরকে সর্বতোভাবে তৈরী থাকতে নির্দেশ দিয়ে আমি আমার বাসভবনে চলে গেলাম। সেখানে গিয়েই আমি আমার অফিসার ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় এম-পি ডাঃ আসহাবুল হক ও স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা, বেসামরিক কর্মচারী প্রমুখদের জরুরীভাবে তলব করে পাঠালাম। ডাঃ আসহাবুল বোধ হয় তৈরীই ছিলেন আমার অপেক্ষায়। খবর পেয়ে ৫ মিনিটের মধে তিনি এসে উপস্থিত হলেন। অন্যান্য সবাই আসার পর আমি তাদেরকে নিয়ে একটা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলাম। ২৫শে মার্চ রাত ১২টার পর থেকে তখন পর্যন্ত ঢাকা এবং অন্যান্য জায়পার আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা ও দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা করলাম। সর্বসম্মতিক্রমে স্থির করা গেল, এ অন্যায় আমরা সইবনা। শপথ নিলাম আমরা এর