পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৩৭

প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ, গাড়ী ও বেতারযন্ত্র ছিল। তুলনামূলকভাবে রেকি ও সাপোর্ট কোম্পানীর ফায়ার পাওয়ার একটা সাধারণ ইনফ্যানট্রি ব্যাটালিয়নের বাংরাদেশেরপ্রয় সমপরিমাণ এই সত্য আমার ভাল করেই জানা ছিল। আমি জানতাম, যুদ্ধের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে আমি অন্ততঃপক্ষে সমান ধ্বংসাত্মক মারণাস্ত্র নিয়ে তিনগুণ সৈন্যের কম হলে ওদেরকে আক্রমণ করতে পারি না। কুষ্টিয়ার শত্রুদের অধিনায়ক ছিলেন মেজর শোয়েব। তার সাথে উপ-অধিনায়করা ছিল ক্যাপ্টেন শাকিল, ক্যাপ্টেন সামাদ ও লেঃ আতাউল্লাহ শাহ।

 আমার মোট সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় ৭০০ জন ইপিআর সৈনিক। তাদের অস্ত্র বলতে ছিল ৩০৩ রাইফেল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ৩০৩ এলএমজি, এমজি ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মর্চে পড়া ৪টা ৩.৫ রকেট লাঞ্চার। গোলাবারুদের সংখ্যা একবারেই ছিল অপর্যাপ্ত। তদুপরি ছিল আধুনিক যুদ্ধে অনভিজ্ঞ ও অশিক্ষিত লোকজন। অফিসার বলতে আমার সাথে ছিল একমাত্র ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী। তবে ভরসা ছিল এই যে আমার সাথে ছিল সমস্ত জনসাধারণ।

 তবুও পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি কিছু সংখ্যক আনসার ও মুজাহিদকে একদিনের ট্রেনিং-এর পর আমার বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করি। স্থানীয় পুলিশ ও আনসারদের ৩০৩ রাইফেলগুলো দ্বারা এই বাহিনীকে সজ্জিত করি।

 আমার কাছে কোন রকম ফিল্ড অয়ারলেস বা ফিল্ড টেলিফোন কম্যুনিকেশনের ব্যবস্থা ছিল না। তাই টেলিফোন বিভাগের সাহায্যে পোড়াদহের খোলা প্রান্তরে ফিল্ড এক্সচেঞ্জ লাগিয়ে দেওয়া হয়। ডঃ আসহাবুল হক সাহেবের সাহায্যে ফিল্ড চিকিৎসা কেন্দ্র, ডাক্তার ও ঔষধের ব্যবস্থা করা হয়। সেনাবাহিনীর ন্যায় খাদ্য সরবরাহের কোন রকম নিয়মিত পদ্ধতি না থাকায় ভলাণ্টিয়ার গ্রুপের কিছু লোকে কুষ্টিয়ায় পাঠিয়ে সেখানকার আওয়ামী লীগ দলের গণ্যমান্যদের সাহায্যে আমার সমস্ত সৈন্যবাহিনীর খাদ্যের পুরোপুরি ব্যবস্থা করা হয়। আরও ব্যবস্থা হয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে প্রয়োজনমত যথাস্থানে ব্যবহার করার। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর হাতিয়ার বলতে ছিল বাঁশের লাঠি।

 ২৮শে মার্চ দুপুর ১২টা পর্যন্ত সীমান্তের সমস্ত কোম্পানী আদেশক্রমে চুয়াডাঙ্গায় সমবেত হয়। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী এক কোম্পানী সৈন্য আমি ঝিনাইদহে পাঠিয়ে দিই ও যশোর-ঝিনাইদহ রাস্তা অবরোধ করে রাখি, যেন যশোর থেকে কোন রকম সৈন্য বা অস্ত্র কুষ্টিয়াকে সরবরাহ করতে না পারে। আর এক কোম্পানী সৈন্যকে ঐদিন বিকেল বেলা ক্যাপ্টেন আজমের নেতৃত্বে চুয়াডাঙ্গা-পোড়াদহ কাঁচা রাস্তা দিয়ে আমি পোড়াদহ পাঠিয়ে দিই। ক্যাপ্টেন আজমের প্রতি নির্দেশ ছিল তার গন্তব্যস্থানে পৌঁছাবার পরেই সে যেন সুবেদার মুজাফফরের কোম্পানীর সাথে যোগাযোগ করে আমাকে রিপোর্ট দেয়। পরিকল্পনা ছিল সুবেদার মুজাফফরের কোম্পানী কুষ্টিয়ার পুলিশ লাইনের দিক দিয়ে আক্রমণ করবে, ক্যাপ্টেন আজমের কোম্পানী শহরের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে-অর্থাৎ সার্কিট হাউসের দিক দিয়ে আক্রমণ করবে এবং একটা প্লাটুন ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কিছু সংখ্যক লোক পূর্ব দিক থেকে মোহিনী মিল ও অয়ারলেস স্টেশনের উপর আক্রমণ চালাবে। আক্রমণ হবেসংযুক্তভাবে একই সময়ে তিন দিক থেকে।

 আক্রমণের সময় ও তারিখ ছিল ২৯শে মার্চ ভোর ৪টা। পরিকল্পনায় এটাও ঠিক করে রাখা হয়েছিল যে, আক্রমণ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে আমার বাহিনীর পশ্চাদভাগে যেন কমপক্ষে ৫ হাজার বেসামরিক লোক আক্রমণের সাথে সাথেই জয়ধ্বনি দিতে দিতে আক্রমণকারী বাহিনীকে অনুসরণ করে। এ সময় বেসামরিক ব্যবস্থার ভার ছিল ডঃ আসহাবুল হকের উপর যিনি তাঁর দলীয় লোক, স্থানীয় ছাত্র ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সাহায্যে খুব সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন করেছিলেন।

 আক্রমণের সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, চলাচল অসুবিধার জন্য ও একটা গাড়ী দুর্ঘটনার কবলে পতিত হওয়ার দরুন সুবেদার মুজাফফরের কোম্পানী নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছতে