পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৩৮

পারেনি। তাই বাধ্য হয়ে আমি আক্রমণের দিন ও সময় ২৪ ঘণ্টা পিছিয়ে দিই। অর্থাৎ আক্রমণের নতুন দিন ও সময় স্থির করি ৩০শে মার্চ ভোর ৪টায়।

 প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, ২৬শে মার্চ সকাল ১০টায় আমার মাসলিয়ায় অবস্থানরত কোম্পানী কমাণ্ডার সুবেদার মজিদ মোল্লা অয়ারলেসে খবর পাঠালেন যে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের প্রথম ব্যাটেলিয়ান, যারা সিনিয়র টাইগার নামে পরিচিত, তাদের সমস্ত সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র সহকারে বাঙ্গালী কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল রেজিউল জলিলের নেতৃত্বে চোগাছায় অবস্থান করছে। এই ব্যাটেলিয়ান নাকি ২৪শে মার্চ তারিখে বাৎসরিক ফিল্ড এক্সসারসাইজের জন্য চৌগাছায় এসেছিল যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে। খবর শুনে আমার মনে বিরাট একটা ভরসা আসল। আমি অয়ারলেসে সুবেদার মজিদ মোল্লাকে দিয়ে আমার তরফ থেকে লিখে পাঠালাম লেঃ কর্নেল জলিলের কাছে। ঐ খবরে আমি লিখেছিলাম যে, ‘দেশের ও দেশের লোকের নিরাপত্তা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বিপর্যস্ত, মা বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠিত, জ্ঞানী-গুণী ও ছাত্ররা হতাহত হচ্ছে। তাই এর বিরুদ্ধে আমি আমার ইপিআর বাহিনীকে নিয়ে বিদ্রোহ করেছি, বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছি। আর কে কি করেছে জানি না। কিন্তু আপনি সিনিয়র, আপনার কাছে সৈন্য আছে, হাতিয়ার আছে। আপনি আসুন অধিনায়কত্ব গ্রহণ করুন। আমরা সম্মিলিত ভাবে এদের হনন করতে সক্ষম হবে।” সুবেদার মজিদ মোল্লা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের প্রথম ব্যাটেলিয়ানে গিয়ে এ সংবাদ তাঁর কাছে পৌঁছায়। কিন্তু অনেক অপেক্ষা করেও তাঁর কাছ থেকে কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। আমাকে এ খবর দেয়ার পর ২৮শে মার্চ আবার এই মর্মে চিঠি লিখে দানেশ নামক এক বিশেষ মুক্তিযোদ্ধাকে তার মোটরসাইকেলে করেই লেঃ কর্নেল জলিলের কাছে পাঠাই। চিঠি তাঁর হাতে পৌঁছানো হয়, কিন্তু নিষ্ফল সব আশা। তিনি কোন রকম আশ্বাস দেয়া দূরের কথা, আমার কার্যকলাপকে আদৌ গুরুত্ব না দিয়ে সেদিনই বিকেল বেলা যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে তাঁর জীপে করে চলে যান এবং ২৯শে মার্চ পত্রবাহক মারফত ব্যাটেলিয়ানের কাছে সংবাদ পাঠান যে, যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে কোন রকম গোলমাল নেই এবং তার আশঙ্কাও নেই, তার পুরো ব্যাটেলিয়ান যেন যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে সেদিনই ফেরত আসে। তদনুযায়ী এই ব্যাটেলিয়ান ২৯শে মার্চ বিকেল পর্যন্ত যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে ফেরত গিয়ে অস্ত্রশস্ত্র জমা করে আপন আপন কাজে লিপ্ত হয়। শুনেছি, ব্রিগেডিয়ার সরদার আব্দুর রহিম দুররানী নাকি রাত্রেই তাদের অস্ত্রাগারের চাবি হস্তগত করে। পরদিন ৩০শে মার্চ সকাল ১০টায় এই ব্যাটেলিয়ানের অস্ত্রবিহীন সৈন্যদের উপর চতুর্দিক থেকে আক্রমণ ও গোলাগুলি বর্ষণ করা হয়। এই আক্রমণে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের প্রথম ব্যাটেলিয়ানের অধিকাংশ সৈন্যই নিরীহভাবে মারা যায়। শুধু লেঃ হাফিজউদ্দিন (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) ও ১৪৮ জন জেসিও এবং অন্যান্য সাধারণ সৈন্য জীবন নিয়ে পালিয়ে এসে আবার ঐ চৌগাছা এলাকায় সমবেত হয়। তাদের অস্ত্র নেই, খাবার নেই, পরনে কাপড় নেই। তারা বহুকষ্টে সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর লোকজনের সাথে যোগাযোগ করে খাদ্য সংগ্রহ করে।

 এদিকে কুষ্টিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রের ঘটনা হলো, ২৮শে মার্চ রাত থেকে ২৯শে মার্চ রাত পর্যন্ত অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে আমাদের সৈন্যদের কুষ্টিয়া শহর থেকে অদূরে মাঠে ময়দানে ও জঙ্গলে অবস্থান করতে হয়। সুবেদার মুজাফফরের কোম্পানী নির্দিষ্ট জায়াগায় পৌঁছতে সক্ষম হয় ২৯শে মার্চ ভোরবেলা। নিয়মিত যোগাযোগ করে তাদেরকে আক্রমণের পরিকল্পনা সুষ্ঠুভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয় এবং যথারীতি অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, ঔষধপত্র ও বেসামরিক লোক সরবরাহ করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০শে মার্চ সকাল ৪টায় তিন দিক থেকে অতর্কিত ভাবে কুষ্টিয়া আক্রমণ করি। আক্রমণের সাথে সাথে অনুসরণকারী জনগণের গগনবিদারী জয়ধ্বনিতে বোধ হয় শত্রুপক্ষের মনোবল ভেঙ্গে যায়। প্রায় ঘণ্টাখানেক তুমুল যুদ্ধের পর আমাদের সৈন্যরা পুলিশ লাইন ও অয়ারলেস কেন্দ্রের ভিতর ঢুকে পড়ে শত্রুহনন করতে থাকে। উপায়ান্তর না দেখে সামান্য সংখ্যক শত্রুসৈন্য তাদের অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দিয়ে দ্রুতগতিতে তাদেরই সদর দপ্তরের দিকে পালিয়ে যায়। পালাবার প্রাক্কালেও অনেকে নিহত হয়। পুরোদিনের যুদ্ধে একমাত্র তাদের সদর দপ্তর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা ব্যতীত সমস্ত শহরই আমাদের হস্তগত হয়। আমার সৈন্যরা শত্রুদেরকে ৩০শে মার্চ সারারাত চতুর্দিক থেকে ঘিরে রেখে মুহুর্মুহু জয়ধ্বনি জহকারে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। শত্রুরা অয়ারলেস সেটের মারফত শত্রুপক্ষের অয়ারলেস আবেদন মনিটরিং করে