পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৪৫

 ওদিকে যুগপৎভাবে পাক সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনী যশোর থেকে আমাদের উপর হামলা চালায়। এই দুই দিক থেকে (সামনে ও পিছন দিক থেকে) হামলা প্রতিহত করার মত সৈন্যবল ও অস্ত্রবল আমার ছিল না। কাজেই, আমার সম্মুখভাগ (ফ্রণ্ট লাইন) সঙ্কুচিত করার উদ্দেশ্যে দুই দিক থেকেই সৈন্য দের অপসারণ করে পিছিয়ে নিয়ে আসি পর্যায়ক্রমে এবং পুনঃপ্রতিরক্ষাব্যূহ গঠন করি কোটচাঁদপুর, ঝিনাইদহ, শৈলকুপা (রাস্তা), পোড়াদহ লাইনে। কিন্তু ১৬ই এপ্রিল অপরাহ্নেই পাকবাহিনীর হাতে ঝিনাইদহের পতন হয়।

 গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার উদ্বোধনঃ অপর পক্ষে ১০ই এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী বলে ঘোষণা করার সাথে সাথেই চুয়াডাঙ্গার উপর চলতে থাকে তীব্র বিমান হামলা। এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার মনস্থির করলেন যে চুয়াডাঙ্গার কোন মুক্ত এলাকাতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে ১৭ই এপ্রিল। নির্বাচন করা হল আমারই পূর্বতন ইপিআর কোম্পনী হেডকোয়ার্টার বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন। সময় সকাল ১০ ঘটিকা। আমি যুদ্ধে ওতপ্রোতভাবে লিপ্ত থাকা বিধায় স্টেজ ও আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার ভার নিলেন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর ৭৬ ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার লেঃ কর্ণেল চক্রবর্তী। স্থানীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও করলেন তিনি। আমাকে শুধু নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হবার জন্য খবর দেয়া হল। ওদিকে প্রতিকুল পরিবেশের মধ্যে ঐ রাতেই সদর দপ্তর মেহেরপুর থেকে ভৈরব নদীর অপর পারে ইছাখালী বিওপিতে স্থানান্তরিত করি। এই বিওপি থেকে ভারতীয় বিওপি'র দুরত্ব ছিল প্রায় ৬০০ গজ। বিওপিতে থাকবার মত কোন ব্যবস্থা না থাকায় সৈন্যদের যথাক্রমে প্লেস করিয়ে গাড়ীতে করে আমার স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে এই প্রথমবারের মত ভারতে পদার্পণ করি।

 সে রাতে সামান্য একটা ঘটনার কথা কোনদিন ভুলতে পারব না। ঘটনাটা হল এই যে, ভারতীয় মাটিতে পদার্পণ করার সাথে সাথেই আমার স্ত্রী নিজেকে অত্যন্ত অসহায় অনুভব করে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। সাথে সাথে কন্যাদের অবস্থাও তথৈবচ। আমার স্ত্রী যতক্ষণ সম্ভব বাংলার মাটিতে কাটাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তাই ফিরে আসা হল আবার সেই ইছাখালীতে। বিওপি'র ভাঙ্গা ঘরে ছিল না কোন বিছানাপত্র, ছিল না কোন শোবার জায়গা। মাটিতে শুয়ে ওরা রাত কাটিয়ে দিল।

 পরদিন ১৭ই এপ্রিল সকাল ১০টায় বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন লোকে লোকারণ্য। অথচ তখনও আমি মেহেরপুরে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী নবগঠিত সরকারকে সালাম দেবার কথা আমারই কিন্তু এদিকে নিশ্চিত না করে রওনা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ওদিকে দেশ-বিদেশের সাংবাদিক সমভিব্যহারে বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে পৌঁছে যান অস্থায়ী প্রেসিডেণ্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এবং অন্যেরা। ভাগ্যবশত তৌফিক এলাহি ও মাহবুবকে আমি ভোর ৭টায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ওখানে। ত্রস্ত গতিতে মাহবুব উপস্থিত কিছুসংখ্যক যুদ্ধক্লান্ত ইপিআর ও আনসার-মুজাহিদের মিলিত সৈন্যদের একত্রিত করে সদ্য আগত প্রেসিডেণ্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে সালাম প্রদান করেন। তার কিছুক্ষণ পরেই আমি ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন (বর্তমানে মেজর), ক্যাপ্টেন হাফিজ, আমার স্ত্রী-কন্যা এবং সামান্য সৈন্য সমভিব্যহারে সেখানে উপস্থিত হই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঘোষণা ও সনদপত্র পাঠের পর এই নবগঠিত সরকারকে আমি সামরিক অভিবাদন দিই। তারপর আনুষঙ্গিক আলাপ-আলোচনা, পরিচয়, ভাষণ ও সবশেষে মধ্যাহ্ন ভোজের পর এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ হয়।

 গৌরবের বিষয় যে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতা লুপ্ত হবার পর আবার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে স্বাধীনতার উন্মেষ অনুষ্ঠানের মত এতবড় একটা ঐতিহাসিক পর্বে স্বাধীণতা যুদ্ধে লিপ্ত কমাণ্ডারদের মধ্যে একমাত্র আমিই এবং বাংলার নারী জাতির প্রতিনিধি হিসাবে আমার স্ত্রী সেখোনে উপস্থিত ছিলেন।

 ফিরে এলাম আমার অস্থায়ী আড়ম্বরহীন সদর দপ্তর ইছাখালী বিওপিতে।