পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৫১

 আমি তাকে আমার বাসায় অবিলম্বে আসতে অনুরোধ করি। অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম যে, ঢাকা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কুষ্টিয়াকে ঢাকায় সেনাবাহিনীর আক্রমণের খবর জানিয়েছেন এবং কুষ্টিয়া এক্সচেঞ্জ মেহেরপুরে এই খবর জানিয়েছে প্রথমে কুষ্টিয়ার সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু যোগাযোগ তার আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একজন অজ্ঞাতনামা অপারেটর রাজারবাগ থেকে উত্তর দেয়, ‘যা বলার বলেছি ত, আর বিরক্ত করবেন না।' আবার অনুরোধ করার পর আর কোন উত্তর পাওয়া গেল না।

 ২৫ শে মার্চ রাত বারটায় মাইকে কুষ্টিয়া শহরের জনগণকে ঢাকাতে পাক বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা জানিয়ে দেয়া হল। সেই মুহূথে থেকে আমি আর পাকিস্তানী সরকারী কর্মচারী রইলাম না। এবং জনগনের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলাম।

 ২৫শে মার্চ রাতে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা পাকাসড়কে গাছ কেটে ব্যারিকেড তৈরী করা হয় এবং মেহেরপুরকে চুয়াডাঙ্গার সাথে বিচ্ছিন্ন করা হয়। মেহেরপুর কুষ্টিয়া রাস্তায় খলশাকুণ্ডী কাঠের পুল ভেঙ্গেচুরে দেয়া হল। এক দল যুবক এই পুলটা ভেংগে দিয়েছিল।

 মেহেরপুরে আনসার কমাণ্ডারকে আমি আদেশ দিই ২৬শে মার্চের মধ্যে মেহেরপুর মহকুমার সমস্ত আনসার ও মুজাহিদকে একত্রিত করার জন্য।

 ২৬শে মার্চ ভোর বেলা। আমার ধারণা হয়েছিল মেহেরপুরকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। আমার মনে হল সমস্ত জনতার মধ্যে এক অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে এবং প্রত্যেকে তার একক সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে এক সম্মিলিত সত্তায় রূপান্তরিত হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেরণা এবং এর অবশ্যম্ভাবী বিজয়ের শক্তি এই জনতার মধ্যে নবরূপান্তরিত সত্তার মধ্যে নিহিত ছিল। প্রত্যেকটা লোক এবং প্রত্যেকটা ছেলে আমার কাছে নতুনভাবে ধরা দিয়েছিল। গায়ের বধূরা পর্যন্ত এই স্বঃস্ফূহর্ত গণজাগরণে অঙ্গাঙ্গীভাবে একাত্মতা অনুভব করেছিল। সেই মুহূর্তে আমি যেন দিব্যচক্ষে পৃথিবীর বড় বড় বিপ্লবকে চাক্ষুষ দেখতে পেলাম।

 সমগ্র পরিস্থিতির আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়নে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, আমাদের যে কোন জায়গা থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতে হবে। এবং শুধুমাত্র ভারতই আমাদের এই সাহায্য করতে পারে। দ্বিতীয়তঃ ভারত-পাকিস্তানের ঐতিহাসিক বিরোধের পটভূমিকায় এটা সুস্পষ্ট ছিল যে, বাংলাদেশের যে কোন সামরিক বা গণঅভ্যূত্থান ভারতের সমর্থন পাবেই। তাই ২৬ শে মার্চ সকালে আমি দু'রকম চিঠি ভারতে পাঠাই। একটা চিঠি পাঠানো হয়েছিল নদীয়া জেলা প্রশাসকের কাছে, যার একটা অনুলিপি পাঠাই লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল চক্রবর্তী (সিও ৭৬ বিএসএফ, বা মেহেরপুর সীমান্তের ভারতে মোতায়েন ছিল) এর কাছে। দ্বিতীয় চিঠি ভারতবর্ষের জনগণকে উদ্দেশ্য পাঠাই। দুটো চিঠিতেই আমি আমার দস্তখত এবং সরকারি সিলমোহর ব্যবহার করি। দ্বিতীয় চিঠিটা ‘অমৃত বাজার' এবং 'যুগান্তর' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ২৭/২৮/২৯/৩০ মার্চ- এর সংখ্যাগুলোতে। 'ডেস্টিনেশন মুজিবনগর' বইটিতে একটা চিঠির ফটোস্টেট কপি মুদ্রিত হয়েছে।

 প্রথম চিঠিটা নদীয়ার জেলা প্রশাসক মিঃ মুখার্জীর কাছে লেখা হয়েছিল। কর্নেল চক্রবর্তী আমাকে বলেছিলেন যে এই চিঠিটা দিল্লীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অনতিবিলম্বে প্রেরণ করা হয়েছিল এবং তারই ফলস্বরূপ ২৯ শে মার্চ বেতাই (ভারতে) বিওপিতে আমাকে দেখা করার খবর পাঠানো হয়।

 ২৯শে মার্চ আমি বেতাই বিওপিতে যাই নদীয়া জেলা প্রশাসক এবং কর্নেল চক্রবর্তী আমাকে সাদরে গ্রহণ করেন এবং স্থানীয় বিএসএফ-এর একটি ছোট দল গার্ড অব অনার প্রদর্শন করে। আমি এবং কর্নের চক্রবর্তী গার্ড অব অনার পরিদর্শন করি। নদীয়া জেলা প্রশাসক আমাকে আনঅফিসিয়াল দূত হিসেবে মর্যাদা দেন।