পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড

 সৈয়দপুর অবস্থিত ৩য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করে সীমান্ত এলাকায় পাঠায়। কুমিল্লায় অবস্থিত ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে পাঠায় ব্রাক্ষণবাড়িয়ায়। উক্ত রেজিমেণ্টের কমাণ্ডার ছিলেন মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশাররফ। ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্টে ছিল চট্টগ্রামে। তাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে চট্টগ্রাম শহর ও বন্দর এলাকায় মোতায়েন করে। ১০ম বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে (ন্যশনাল সার্ভিস ব্যাটালিয়ন, যার অধিকাংশই ছাত্রদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল) ২৫শে মার্চের পূর্বেই ঢাকায় নিরস্ত্র করে। এছাড়াও ৬০৪ ফিল্ড ইনটেলিজেন্স ইউনিটের প্রায় ২৫ জন বাঙ্গালীকে (যার সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড ছিলাম আমি নিজেই) নিরস্ত্র করা হয়। শুধুমাত্র আমার অস্ত্রটা নিতে তারা সাহস করে নাই। তাছাড়া ঢাকায় অবস্থানরত নিম্নপদের সৈন্যগণ-যেমন সিগনাল রেজিমেণ্ট, ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন, ৬০৪ কম্বাইণ্ড ওয়ার্কশপ, ১৪৭ ইনফ্যানট্রি ওয়ার্কশপ, সাপ্লাই এণ্ড ট্রান্সপোর্ট ব্যাটালিয়ন, স্টেশন সাপ্লাই ডিপো, গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরী, কম্বাইণ্ড অর্ডন্যান্স ডিপো, স্টেশন সাপ্লাই ডিপো, ট্রানজিট ক্যাম্প, ফিল্ড এ্যাম্বুলেন্স ও পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর সমস্ত সৈন্যদেরকে অতি কায়দায় ও চালাকি করে নিরস্ত্র করে। বাঙ্গালীকে কেন নিরস্ত্র করা হচ্ছে পাঞ্জাবীরা তার কারণসরূপ দেখায় যে, যারা বাঙ্গালী তারা বাঙ্গালী আইনশৃংখলা ভঙ্গকারী জনগণের উপর গুলি চালাতে সক্ষম হবে না। জনগণের উপর গুলি চালাতে আমাদের মায়ামমতা লাগা স্বাভাবিক। কাজেই পাঞ্জাবীদের হাতে অস্ত্র কম থাকায় আমাদের অস্ত্র নিয়ে আইন-শৃংখলা স্বাভাবিক ও আয়ত্তে আনার চেষ্টা করবে- এই কারণেই আমাদের কাছ থেকে অস্ত্র নিচ্ছে।

 অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন শাহেদ নসরুল্লাহ (ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র) আমার অফিসে প্রায়ই দেখা করত ও আমার নিকট থেকে খবরাখবর নিত। শাহেদ নাসরুল্লাহ এভাবে আসা-যাওয়া করাতে আমাকে আমার অফিসার কমাণ্ডিং মেজর মনোয়ার হোসেন জিজ্ঞাসা করেন যে ছেলেটি কে এবং কেন আসে। আমি আমার আত্মীয় বলে পরিচয় দেই এবং জানাই যে, যেহেতু আমাকে ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে বের হতে দেওয়া হয় না সেজন্য আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। পরে একদিন শাহেদ নাসরুল্লহ যখন আমার অফিস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন রাস্তায় মেজর মনোয়ার হোসেনের হাওয়ালদার মোঃ আশরাফ তার ফটো তুলে নেয়।

 পরদিন নসরুল্লাহ আমার নিকট এসে হাওলাদার কর্তৃক তার ফটো তোলার কাথা জানায়। আমি নসরুল্লাহকে সাহস দিয়ে বলি ওতে কিছু হবে না। এরপর পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভূট্টো যখন ঢাকায় আসে ও হোটেল ইণ্টারকণ্টিনেণ্টালে থাকে তখন শাহেদ নসরুল্লাহসহ ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে একটি ছাত্র ও গণবিক্ষোভ মিছিল হোটেল ইণ্টারকণ্টিনেণ্টালে পৌঁছে এবং ভুট্টোকে নিন্দা করে বিভিন্ন শ্লোগান দেয়। ঐ মিছিলে শাহেদ নসরুল্লাহর শ্লোগান দেওয়া ফটোটি ‘দি পিপল’ পত্রিকায় দেখা যায়। পিপল পত্রিকায় নসরুল্লাহর ফটো দেখা মাত্র মেজর মনোয়ার হোসেন আমাকে ডেকে বলেন, যে ছেলেটি তোমার নিকট আসে ও তোমার আত্মীয়, সে তো একজন ছাত্রনেতা সে ছেলেটি মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিল। তিনি পিপল পত্রিকাটির কপি এনে আমাকে দেখান। তখন আমি মেজর মনোয়ার হোসেনকে জানাই যে আমি সঠিক কিছু বুঝতে পারছি না, সে তো কোনদিন ছাত্ররাজনীতি করতো না। এর থেকে মেজর মনোয়ার হোসেন আমাকে আরও বেশী সন্দেহের চোখে দেখেন।

 এরপর ১৫ই মার্চ থেকে ২৩শে মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খানের ঢাকা আগমন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার অগ্রগতির কথা শুনে আমরা কিছুটা আশাবাদী হিলাম যে তারা সম্ভবত আওয়ামী লীগকে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। আমরা বাঙ্গালী অফিসাররাও পাঞ্জাবীদের মতিগতিকে তেমনভাবে লক্ষ্য করতাম না আওয়ামী লীগ ক্ষমতা পাবে মনে করে (আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীনের প্রেসনোটের উপর ভিত্তি করে)।

 ২৩শে মার্চ প্রদেশব্যাপী ছাত্র ও গণহত্যার প্রতিবাদে ঢাকায় প্রত্যেক বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে বাংলাদেশের পতাকা ও কালো পতাকা উত্তোলিত হয় এবং ২৪শে মার্চ সকালে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রেসিডেণ্ট