পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৫৫

ব্যাটালিয়নের চেয়ে অনেক বেশি। শহরের উপকণ্ঠে, অনেকটা অবরোধের মত, প্রথমে মুক্তি বাহিনীকে যার মধ্যে ইপিআর রা ছিলেন মূলশক্তি- মোতায়েন করা হয়। আমাদের অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল পুরানো ৩০৩ রাইফেল এবং কিছু পুরনো এসএমজি। ইপিআর ছাড়া আনসার এবং মুজাহিদদের কাছে ১০ রাউণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০ রাউণ্ডের মতো গুলি ছিল।

 ৩০শে মার্চ সকালে অবরোধের স্থানগুলো থেকে যুগপৎভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অবস্থানের উপর অতর্কিতে গুলিবর্ষণ শুরু করা হয় এবং সাথে সাথে আমাদের প্রত্যেকটি অবস্থানের পিছনে সমবেত হাজার হাজার লোক গগন বিদারী আওয়াজে “জয় বাংলা” ধ্বনি তোলে এবং শ্লোগান দিতে দিতে মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রসর হতে থাকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই অতর্কিত আক্রমণে, জনতার এই আকাশফাটা চিৎকারে এবং রাইফেল ছাড়াও কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের আওয়াজে দিশেহারা এবং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এটা তাদের কল্পনাতীত ছিল যে, বাঙ্গালী ইপিআর-এর জোয়ারা ঐ অল্প সময়ের মধ্যে তাদের নিজেদেরকে সংগঠিত করে সুসজ্জিত বিক্ষিপ্ত দলগুলো এই আক্রমণের মুখে তাদের কুষ্টিয়া সেনাবাহিনী সদর দফতরের দিকে পিছিয়ে পড়তে থাকে। তাদের এই পশ্চাদপসরণে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও মনোবল দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য এই আক্রমণ ছিল সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিজনক। কারণ, তারা বুঝতে পারেনি কারা কোথা থেকে তাদের উপর এই আক্রমণ চালাচ্ছে এবং কেন? এই পশ্চাদপসরণই তাদের জন্য কাল হল। কারণ প্রত্যেকটি ঘটনার সাথে সাথে তাদের মনোবল ভেংগে যাচ্ছিল এবং আমাদের মনোবল উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এভাবে যুদ্ধ সারাদিন চলতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে তারা তাদের অবস্থান থেকে পুল আউট করে কুষ্টিয়া জেলাস্কুল এবং সার্কিট হাউসে একত্রিত হতে থাকে। এবং এটাই তাদের জন্য কাল হয়। আমরাও তাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। আমাদের অবরোধের তিন দিক থেকে জেলা স্কুল এবং সার্কিট হাউস ঘিরে ফেলে, যদিও তখন পর্যন্ত কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ রাস্তার কয়েক মাইল জনশক্তির অভাবে আমাদের আয়ত্তাধীন ছিল না। পরে অবশ্য আমরা এই দল থেকে বন্দী লেফটেন্যাণ্ট আতাউল্লাহর কাছ থেকে জানতে পারি যে, মেজর শোয়েব এবং অন্যান্য অফিসাররা রিইনফোর্সমেণ্ট-এর জন্য বার বার অনুরোধ জানাচ্ছিলেন যশোহর সদর দফতরকে। কিন্তু যশোহর সদর দফতর তাদেরকে কোন সাহায্যের আশ্বাস দিচ্ছিল না। এতে তথাকথিত দুর্ধর্ষ ২২ এফএফ একেবারে ইঁদুরের মত হয়ে যায়। তারা পালাবার পথ খুঁজতে শুরু করে। ৩১শে মার্চ থেকে তারা পলায়ন করতে শুরু করে।

 মুক্তিবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে আনুমানিক ২০ জন পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়েছিল। বাকি দুই কোম্পানির অনধিক সৈন্য সবাই জনতার সাথে সংঘর্ষে নিহত হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কুষ্টিয়া হতে ঝিনাইদহের পথে একটা পুলের উপর মুক্তিবাহিনী একটা বিরাট খাদ খনন করে ক্যামোফ্লেজ করে রেখেছিল। মেজর শোয়েব এবং ২২ এফএফ-এর কিছু অফিসার এবং সৈনিক গাড়ীতে করে যশোহরের দিকে পশ্চাদপসরন করার সময় এই খাদে পড়ে যায় এবং তারপর যারা বাঁচতে পেরেছিল তারা পার্শ্ববর্তী গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার সাধারণ মানুষের এই সময়কার সাহসিকতা পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল। তাদের স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে বাংলার গ্রামের আবাল-বৃদ্ধবণিতা সমষ্টিগতভাবে রুখে দাঁড়ায়। এই সংঘর্ষে যদিও অনেক সাধারণ বাংগালী নিহত হয় তবুও ২২ এফএফ-কেউ যশোহর ফিরে যেতে পারেনি। কড়াল, কাস্তে বা কোন সময় একেবারে খালি হাতে কোন সময়বা গাছ থেকে অতর্কিতে সাধারণ জনগণ এদের মোকাবিলা করে। আমরা ১লা এপ্রিল থেকে অনবরত এই গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র পেতে থাকি যা তারা পাক সেনাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল।

 আজো একটি কিশোরের কথা মনে পড়ে, যে একটা শর্টগান নিয়ে তিনজন পাকসেনাকে অনুসরণ করে, যাদের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ছিল। সে নিজের বুদ্ধিবলে শর্টগান দিয়ে তিনজন পাকসেনাকে খতম করে এবং ওদের অস্ত্রশস্ত্র আমাদের কাছে জমা দেয়। পরে কুষ্টিয়া মুক্তিবাহিনীর দখলে আসার পর আমাদের দখলীকৃত অস্ত্রসম্ভারের হিসাব নিতে গিয়ে আমরা আশ্চর্য হয়ে যাই। যে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ২২ এফএফ পশ্চাদপসরন করে মনোবল থাকলে ঐ অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে তারা এক পক্ষকাল যুদ্ধ করতে পারত। হয়ত আমাদেরকে পরাজিত করতে