পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৫৬

পারত। ২২ এফএফ-এর এই পরাজয় এবং মুক্তিবাহিনীর জয়ে আমাদের মনোবল দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আমরা বিশ্বাস করতে থাকি আমাদের বিজয়ের গতি অপ্রতিহত থাকবে এবং অচিরেই পদ্মার পশ্চিমাঞ্চলকে আমরা পুরোপুরি মুক্ত করতে পারব। কিন্তু সামরিক জ্ঞানের অভাবে আমরা বুঝতেই পারিনি যে এক সুসজ্জিত সেনবাহিনী কিভাবে আবার মরণ কামর হানতে পারে।

 আমার যতদূর মনে পড়ে কুষ্টিয়াতে আমরা ৩৫টি গাড়ী, ৬টি আর-আর গান সহ শতাধিক রাইফেল, এলএমজি এবং ভারী মেশিনগান এবং গোলাবারুদ দখল করি, যা দিয়ে আমরা মুক্তিবাহিনীকে সুসজ্জিত করতে থাকি। এই দখলকৃত অস্ত্রসম্ভার এবং গাড়ী আমরা চুয়াডাঙ্গায় এনে জনগণকে প্রদর্শন করি, যা অনেক বিদেশী সাংবাদিক এবং টেলিভিশন সংস্থা পর্যবেক্ষণ করে।

 এই সময় এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কোন একদিন একটি ফরাসি-স্পেনিশ টেলিভিশন সংস্থার প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় ৩টি পাকিস্তানী স্যাবর জেট চুয়াডাঙ্গা আক্রমন করে এবং আধঘণ্টা পর্যন্ত গোলাবর্ষণ করে এবং কয়েক জায়গায় বোমা বর্ষণ করে। এই টেলিভিশন সংস্থা অত্যন্ত সাহসিতার সাথে এই ঘটনার পুরোপুরি আলোকচিত্র গ্রহণ করে, যা সারা বিশ্বে তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল এই ছবিগুলো নিশ্চয়ই বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করতে বিশেষ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল।

 এই সময় মুক্তিবাহিনীর ক্ষুদ্র একটি দলকে কুষ্টিয়ায় রেখে আমরা নতুন সমর পরিকল্পনা গ্রহন করি। আমরা যশোহর থেকে মাত্র কয়েক মাইল উত্তরে বিশাখালীতে আমাদের প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলি। মাহবুব এই এলাকার সামরিক নেতৃত্ব গ্রহণ করে। বিশাখালীতে আমাদের দুই কোম্পানিরও কম সৈন্য ছিল। উত্তর-পূর্বে আমরা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উভয় পার্শ্বে ঢাকা হতে আক্রমণ প্রতিহত করার প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরী করি। হার্ডিঞ্জ ব্রীজে আমাদের দুই প্লাটুনেরও কম ইপিআর জোয়ান ছিল। এই সময়কার টেলিফোন কর্মচারীদের সহায়তা এবং তাদের দেশপ্রেম আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

 উপরোল্লিখিত কয়েকটি জায়গার সাথে আমরা সব সময় যোগাযোগ রক্ষা করে ছিলাম। রাজশাহী এবং পাবনায় পাক সেনাদের তৎপরতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনা সম্বন্ধে অবহিত ছিলাম। গোয়ালন্দ মহকুমার প্রশাসক শাহ মোহাম্মদ ফরিদের অনুরোধে আমরা একটি ক্ষুদ্র ইপিআর বাহিনীকে গোয়ালন্দে শত্রুকে মোকাবেলা করার জন্য প্রেরণ করি। এমনকি আমরা পাবনা দখলের পর নগরবাড়ি ঘাটে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য ক্ষুদ্র একটি বাহিনী প্রেরণের প্রস্তুতি নিই। আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল যশোহরে পাকসেনাকে কোণঠাসা করা এবং ঢাকা হতে কোন রকম রিইনফোর্সমেণ্ট বা আক্রমণকে প্রতিরোধ করা।

 সামরিক প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত যে কোন ব্যক্তির কাছে এটা প্রতীয়মান যে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইপিআর বাহিনীর পক্ষে এই সামরিক ভূমিকা পালন করা অসম্ভব ছিল। এবং কোন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী এই প্রস্তুতি নিতে কোন দিনই সাহস পেত না। তবুও দেশপ্রেমের উন্মাদনা আমাদেরকে পেয়েছিল, তাই যা করা সম্ভব নয় তা করার সাহস এবং প্রস্তুতি আমরা নিয়েছিলাম।

 এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আমরা কুষ্টিয়া যশোর, (শুধু সেনানিবাসকে বাদ দিয়ে), ফরিদপুর,পাবনা রাজশাহীকে মুক্তাঞ্চর হিসেবে ঘোষণা করি এবং আমাদের নিজস্ব সীলমোহরও বানাই। শুধু তাই নয়, গোয়ালন্দ থেকে কুষ্টিয়া এবং কুষ্টিয়া থেকে দর্শনা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল চালু করতে শুরু করি। আমরা এই সময় ব্যাংকেও নির্দেশ দেই ৫০০ টাকার উপরে কাউকে কোন পেমেণ্ট না করতে। এমনকি ভারতের সাথে আমাদের এই বোঝাপড়া হয় যে আমার সরকারী সীলমোহর এবং দস্তখত করা সার্টিফিকেট মোটামুটি পাসপোর্টের মর্যাদা পাবে। এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত এটা বলবৎ ছিল- অর্থাৎ আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম সরকারের প্রশাসন