পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৬৬

 ব্রিগেডিয়ার দুরোনী চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সৈন্যরাও তৎক্ষণাৎ ‘জয় বাংলা' ধ্বনি দিতে দিতে অস্ত্রাগারের তালা ভেঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র যার যার হাতে নিয়ে নেয় এবং আমরা চতুর্দিকে আমাদের পজিশন নিই। আমাদের বিদ্রোহের খবর পাওয়ার সাথে সাথে পাকিস্তানী দুই ব্যাটালিয়ন (২৫-বেলুচ রেজিমেণ্ট এবং ২২তম ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স) সৈন্য আমাদেরকে তিন দিক দিয়ে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের জোয়ানরা অত্যন্ত দৃঢ়তা ও দক্ষতার সাথে তাদের আক্রমণকে প্রতিহত করে। এ সময় কমাণ্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল জলিল আমাদের নেতৃত্ব দিতে অস্বীকার করেন এবং অফিসে বসে থাকেন। তখন আমি ব্যাটালিয়নের নেতৃত্ব নিই এবং পাঞ্জাবীদের আক্রমণকে প্রতিহত করার প্রস্তুতি নিই এবং সেভাবে সৈন্যদের পুনর্গঠিত করি। সেকেণ্ড লেফটেন্যণ্ট আনোয়ার হোসেনও আমার সঙ্গে বিদ্রোহে যোগদান করে।

 এভাবে সকাল আটটা থেকে দুপুর দু'টা পর্যন্ত পাঞ্জাবীরা আমাদের উপর বার বার আক্রমণ করে, কিন্তু প্রত্যেকবারই আমরা তাদের আক্রমণকে প্রতিহত করি এবং তাদের আক্রমণকে ব্যর্থ করতে সক্ষম হই। পাকিস্তানীরা পূর্ব থেকেই আমাদের উপর আক্রমণাত্মক প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা নিয়েছিল, কেননা তারা মর্টার আক্রমণ করে এবং তা আমাদের ব্যাটালিয়নের উপরই করে। যেহেতু, পূর্বপরিকল্পনা নিয়ে পাকিস্তানীরা আমাদের উপর আক্রমণ করে, সেহেতু তাদের সঙ্গে আমরা বেশীক্ষণ যুদ্ধ চালাতে পারব না মনে করে আমি আমার ব্যাটালিয়ন নিয়ে ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

 পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদেরকে উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিক দিয়ে আক্রমণ করেছিল। পশ্চিম দিক দিয়ে আক্রমণ না করলেও পশ্চিমের খোলা মাঠে মাঝে মাঝে অবিরাম বৃষ্টির মত গুলি করছিল। আমরা পশ্চিম দিক দিয়েই কভারিং ফাইটের সাহায্যে বের হবার সিন্ধান্ত নিলাম। পশ্চিম দিক দিয়ে কভারিং ফাইটের সাহায্যে বের হবার সময় ছোট ছোট দলে বিভক্ত হই। (চৌগাছা যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে ১০ মাইল দক্ষিণ- পশ্চিমে) ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে বের হবার সময় আমি আমার কমাণ্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল জলিলকে আমাদের সঙ্গে বিদ্রোহ করার জন্য অনুরোধ করি। কিন্তু তিনি মোটেই রাজী হননি।

 যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে যুদ্ধের সময় সেকেণ্ড অফিসার লেফেটেন্যাণ্ট আনোয়ার হোসেন শহীদ হন। তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন। তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে “বীর উত্তম” উপাধিতে ভূষিত করেন। সেকেণ্ড লেফেটেন্যাণ্ট আনোয়ারই প্রথম অফিসার যিনি যুদ্ধে শহীদ হন। তাছাড়া এ যুদ্ধে আমার ৪০ জন সৈন্য শহীদ হন। পাকিস্তানী সৈন্যও প্রায় ৪০ জন শহীদ হন।

 চৌগাছায় একত্রিত হবার পর আমরা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলি। এসময় আমি একমাত্র অফিসার ছিলাম। দশজন জুনিয়র কমিশন অফিসারও আমার সাথে প্রায় ২২৫ জন সৈন্য ছিল।

 ৩০শে মার্চ, ১৯৭১০৪ এইদিন রাত্রে জনসাধারণের মারফতই প্রথম জানতে পারলাম যে, মেজর জিয়াউর রহমান সাহেব চট্টগ্রাম থেকে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন এবং যুদ্ধের জন্য সমস্ত বাঙ্গালী সৈন্যদের আহবান করেছেন। কয়েকজন সাংবাদিকও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাদের নিকট জানতে পারলাম সারা বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ও ইপিআর বাহিনীর সৈন্য ও অফিসাররা পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। এ খবর পাবার পর আমার এবং আমার সৈন্যদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ দেখা দেয় এবং মনোবল অত্যন্ত দৃঢ় হয়।

 ৩০শে মার্চ, ১৯৭১ঃ এই দিন আমার ব্যাটালিয়নে সমস্ত সৈন্যদের একত্রিত করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং মুক্তি সংগ্রাম সম্পর্কে তাদের অবহিত করলাম। তাদের উদ্দেশ্য করে সংক্ষিপ্ত ভাষণে জানালাম যে, বাংলাদেশর স্বাধীনতার জন্য স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছে। স্ব-ইচ্ছায় যে বা যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মবিসর্জন দিতে প্রস্ত্তত শুধু তারাই আমার ব্যাটালিয়নে থাকতে পারবে। এবং আরও বললাম, যদি কারো যুদ্ধ