পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৬৭

করার ইচ্ছা না থাকে তবে সে কেটে পড়তে পারে। আমার বক্তব্য শুনে প্রত্যেক জোয়ানের মুখে নতুন করে উদ্দীপনা দেখা দেয়। তারা সবাই দেশের জন্য আত্মবিসর্জন দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় এবং শপথ গ্রহণ করে।

 চৌগাছায় আমার ও আমার ব্যাটালিয়নের যুদ্ধ করার মত কোন গোলাবারুদ ছিল না। আমাদের সঙ্গে যে সমস্ত গোলাবারুদ ছিল তা যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টের যুদ্ধেই প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাছারা সকলেরই একটা করে পোশাক ছিল। খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধা দেখা দেয়। মোটকথা, বিভিন্ন সমস্যর সম্মুখীন হই। কিন্তু ছাত্র ও জনসাধারণের সাক্রিয় সাহায্যে আমাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাবস্থা হয়।

 ২রা এপ্রিলঃ চৌগাছা থেকে সলুয়া নামক গ্রামে নায়েক সুবেদার এ বি সিদ্দিকের কমাণ্ডে এক কোম্পানী সৈন্য পাঠাই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য। (সলুয়া গ্রাম যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে ৫ মাইল পশ্চিম দিকে)। চৌগাছা তখন আমার হেড কোয়ার্টার। এখান থেকে যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টের পশ্চিম ও উত্তর দিকের গ্রামগুলোতে পেট্রোলিং শুরু করি। হাবিলদার আবুল কাশেম (টি-জে) এবং হাবিলদার মোহাম্মদ ইব্রাহীমদের নেতৃত্বে যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে প্রায় ১ মাইল পশ্চিমে খিতিবদিয়া নামক গ্রামে এ্যামবুশ পার্টি পাঠাই। হাবিলদার আবুল কাশেম এবং হাবিলদার ইব্রাহীম একটি পাকিস্তানী পেট্রোল পার্টিকে এ্যামবুশ করে। এতে ৬ জন পাকিস্তানী নিহত হয় এবং ৮ জন গুরুতরভাবে আহত হয়।

 ইতিমধ্যে ৭ই এপ্রিল খবর পেলাম যে, মেজর ওসমান চৌধুরী (বর্তমান লেঃ কর্নেল) চুয়াডাঙ্গায় তার ইপিআর বাহিনী নিয়ে মুক্তিসংগ্রামে যোগদান করেছেন। ঐদিন আমি একটা জীপ নিয়ে চুয়াডাঙ্গায় মেজর ওসমান চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার নিকট থেকে কিছু চাইনিজ এম্যুনিশন, এক্সপ্লোসিভ, কয়েকটি জীপ এবং কয়েকটি রিকয়েললেস রাইফেল নিয়ে চৌগাছায় ফিরে আসি।

 ১০ই এপ্রিল, ১৯৭১ নায়েক সুবেদার আহমেদউল্লাহর নেতৃত্বে কয়েকজন সৈন্যকে পাঠালাম ছোট হায়বতপুর গ্রামের ব্রীজ ধ্বংস করার জন্য। ব্রীজটি যশোর-ঝিনাইদহ বড় রাস্তায় যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে ৫ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। ভোর তিনটের সময় নায়েক সুবেদার আহমেদউল্লাহ উক্ত ব্রীজ উড়িয়ে দেন। ব্রীজটি ভাঙ্গার ফলে এবং ক্যাণ্টনমেণ্টের চতুর্দিকে আমার ব্যাটালিয়ন সৈন্যদের পেট্রোলিং-এর দরুণ পাকিস্তনী সেনাবাহিনীর সৈন্যরা ক্যাণ্টনমেণ্ট এলাকা থেকে কিছুদিনের জন্য ভয়ে বের হতে পারেনি।

 ১১ই এপ্রিল, ১৯৭১ঃ সিপাই ড্রাইভার কালা মিয়াকে পাঠাই কোটচাঁদপুর থানায় কয়েকটি জীপ ও ট্রাক সংগ্রহ করে আনতে। কালা মিয়া কোটচাঁদপুর যাবার পথে খবর পায় যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা কনভয় কালিগঞ্জের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। উক্ত খবর পাবার পর কালা মিয়া আশেপাশের গ্রাম থেকে কয়েকজন (দশজন) মুজাহিদকে নিয়ে কালিগঞ্জের দিকে এক মাইল দূরে এ্যামবুশ করে। উক্ত এ্যামবুশে ৩টা গাড়ি বিনষ্ট হয় এবং দশজন পাকিস্তানী সৈন্যও নিহত হয়। কালা মিয়া একটা হ্যাণ্ড গ্রেনেড নিয়ে যখন একটা গাড়ির দিকে ছুড়তে যায় তখন তার বুকে পাঞ্জাবদদের বুলেট বিদ্ধ হয় এবং সে সঙ্গে সঙ্গে শহীদ হয়।

 ১৪ই এপ্রিল, ১৯৭১: ইতিমধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্যরা বেনাপোলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, এ খবর পেয়ে ১৪ই এপ্রিল আমি আমার ব্যাটালিয়ন চৌগাছা থেকে তুলে নিয়ে বেনাপোলের ৩ মাইল পূর্বে কাগজপুকুর গ্রামে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করি এবং যশোর-বেনাপোল রাস্তার দুধারে প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা নিই। এই সময় ইপিআর বাহিনীর দু'টো কোম্পানী যোগদান করে। আমার সৈন্যসংখ্য প্রায় ৫৫০ জনে দাঁড়ায়। এ সময় শত্রুর শক্ত ঘাঁটি ছিল নাভারনে। (নাভারন বেনাপোল থেকে ১২/১৩ মাইল পূর্ব দিকে)। আমি শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য নাভারন এলাকায় পেট্রলিং শুরু করি।

 ২১শে এপ্রিল, ১৯৭১: ঐ দিন ভোর আড়াইটার সময় আমি নিজে ২০ জন সৈন্য নিয়ে নাভারন মূল ঘাঁটিতে পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর রেইড করি। আমার রেইডে ১০ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয় এবং ১৫ জন আহত