পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৭২

 এপ্রিলের মধ্যভাগ। ইতিমধ্যে পাকসৈন্যরা যশোরের গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন অঞ্চলে আত্মগোপন করে হামলাকারীদের উপর চোরা-গোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। যশোর শহর থেকে দশ-বারো মাইল দূরে মুরাদপুর গ্রাম। বারো বাজারের পাশেই মুরাদগড়। এখানে মুক্তিবাহিনীর একটি গোপন ঘাঁটি ছিল। খবর পাওয়া গেল যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে কিছু সৈন্য মুরাদগড়ের দিকে আসছে। সুখবর। এই শিকারটা যেন ফসকে না যায়। স্থির হলো এদের উপর অতর্কিত হানা দিতে হবে। ভাগ্যক্রমে এদের হাতে একটি লাইট মেশিনগান ছিল। এমন সুযোগ কি সবসময় মেলে! কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় মাত্র তিনজন একজন ক্যাপ্টেন আর দু'জন তার সহকারী। খবর পাওয়া গেছে ওদের সঙ্গে আছে পাঁচখানা জীপ, আর একখানা ট্রাক। সৈন্যসংখ্যা সবসুদ্ধ শ'খানেক হবে। একশ জনের বিরুদ্ধে তিনজন। হোক তিনজন, এই নিয়েই তারা ওদের প্রতিরোধ দেবে।

 যথাসময়ে ওদের সেই 'কনভয়' মুরাদগড়ে এসে পৌঁছলে ওরা কালীগঞ্জের দিকে চলেছিল। মুরাদগড়ের পুলটা যেখানে তারই একপাশে ঘন ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে সেই তিনজন মুক্তিযোদ্ধা পজিশন নিয়ে বসেছিল। পাক সৈন্যরা নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে চলেছিল। তাদের বাধা দেবার দুঃসাহস যে কারও থাকতে পারে এটা তারা ভাবতে পারেনি। তাদের দুটো জীপ সবেমাত্র পুলটা পেরিয়ে ওপারে গেছে, এমন সময় মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগানটি তাদের লক্ষ্য করে গর্জন করে উঠল।

 এ অতর্কিতভাবে আক্রান্ত হয়ে পাক-সৈন্যরা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। এদিকে ওদের মেশিনগান অবিরল ধারায় গুলিবর্ষণ করে চলেছে। ফলে তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকে ছুটল।

 একটু বাদেই এই ভগ্নদূতের দল হাঁপাতে হাঁপাতে ক্যাণ্টনমেণ্টে গিয়ে এই সংবাদ পৌঁছল। দেখতে দেখতে এক বিপুল বাহিনী বেরিয়ে এলে ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে। ট্রাক-বোঝাই সৈন্যদল বিদ্যুৎ বেগে ছুটে গিয়ে মুরাদগড়কে কেন্দ্র করে একটা বিরাট অঞ্চল ঘেরাও করে ফেলল। মুক্তিযোদ্ধারা ওদের সেই ঘেরাও-এর মধ্যে আটকে পড়ে গিয়েছিল। বেরিয়ে যাওয়ার কোন পথ ছিল না। সেই তিনজন বীরযোদ্ধা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হলো।

মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রউফ

 বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হবার ঠিক অল্প কিছু কাল আগেই কর্তৃপক্ষ আবদুর রউফকে পাকিস্তান থেকে তাঁর স্বদেশে নিয়ে আসেন। তারপর থেকে যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে বেঙ্গল রেজিমেণ্টের দলভুক্ত হয়েছিলেন। ইতিমধ্যে সারা বাংলাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলন উত্তাল তরঙ্গ নিয়ে গর্জন করে উঠেছে। স্বাধীনতার এই দুর্বার কামনাকে দমন করবার জন্য সামরিক সরকার ২৫-এ মার্চ রাত্রিতে ঢাকা শহরের বুকে হত্যা ও ধ্বংসের তাণ্ডব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে সারা প্রদেশময় তার প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল জনতা, দিতে দিকে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠতে লাগল।

 যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে তখন বেঙ্গল রেজিমেণ্টের এক ব্যাটালিয়ন বাঙ্গালী সৈন্য। পশ্চিম পাকিস্তানের ফ্রণ্টিয়ার ও বেলুচ বাহিনীর হাজার হাজার সৈন্যের মধ্যে তারা একেবারেই সংখ্যালঘু। তাই ভেতরে ভেতরে বিক্ষোভে ফেটে পড়লেও তারা প্রথম দিকে কোন অসন্তোষ বা বিদ্রোহের ভাব প্রকাশ করেনি।

 কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক অফিসাররা তাদের বিশ্বাস করতে পারেনি। ২৯-এ মার্চ পর্যন্ত মানুষের মনের অবস্থা যাই থাক না কেন যশোরে নাগরিক জীবন স্বাভাবিকভাবেই বয়ে চলেছিল। কিন্তু ৩০-এ মার্চ তারিখে যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টের ভেতরে অবাঙ্গালী ও বাঙ্গালী সৈন্যদের মধ্যে এক প্রচণ্ড সংঘর্ষ ঘটল। পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক অফিসাররা বেঙ্গল রেজিমেণ্টের অস্ত্রাগারের চাবি কেড়ে নিয়ে সমস্ত বাঙ্গালী সৈন্যদের নিরস্ত্র