পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৭৭

চলবে। কিন্তু কি আশ্চর্য এই ফায়েকুজ্জামান বন্ধ দরজাটা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল সে। কিন্তু আমাদের মুখের দিকে তাকাতেই, কে জানে কি করে আমার আসল রুপ আর আসল উদ্দেশ্যটা ধরে ফেলল। এতগুলি লোককে ঘোল খাইয়ে এলাম, কিন্তু তার সাবধানী চোখ দু'টিকে ফাঁকি দিতে পারিনি। আতঙ্কিত দৃষ্টি নিয়ে এক লাফে ঘরে ঢুকে পড়ল সে, তারপর দরজার পাট দুটো আমাদের মুখের সামনে দড়াম করে বন্ধ করে দিল।

 ইতিমধ্যে ঘরের ভিতর থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। আমাদেরও কেমন জিদ চেপে গেছে, আমরা বাইরে থেকে পাল্টা গুলি চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু একটু বাদেই নিজেদের ভুলটা বুঝতে পারলাম। ইতিমধ্যে সারা শহর চঞ্চল হয়ে উঠেছে। পথের মোড়ে মোড়ে ভীড় জমে যাচ্ছে। এর পর আর শহর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার উপায় থাকবে না। অবস্থার গুরুত্বটা বুঝতে পেরে কাজটা অসামপ্ত রেখেই আমর ছুটে বেরিয়ে পড়লাম। আমরা ছুটছি, আর ফাঁকা আওয়াজ করে চলেছি, সঙ্গে রাস্তা সাফ যাচ্ছে।

 নিরাপদে, সম্পূর্ণ অক্ষত দেহে শহরের বাহিরে বেরিয়ে এলাম মৃত্যুর গহবর থেকে।

 প্রকাশ্য দিবালোকে গোপালগঞ্জ শহরের বুকের উপর এই সমস্ত ঘটনা ঘটে যাবার পর অবস্থা গরম হয়ে উঠল। সামরিক বাহিনী আর তাদের দালালরা মুক্তিবাহিন কে নির্মূল করার জন্য উঠে পড়ে লাগল। আমরা যে অঞ্চলে ছিলাম সেখানকার জনসাধারণের উপর নানারকম জুলুম আর অত্যাচার চলল। শেষ পর্যন্ত আমরা তিনজন ঐ অঞ্চল ছেড়ে মাণিকহার গ্রামে চলে এলাম। আমরা যেখানেই যাই সেখানেই স্থানীয়ভাবে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠে। তাছাড়া দীর্ঘলিয়া আর চন্দ্রদীঘলিয়ার মুক্তিযোদ্ধারাও সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল।

 মাণিকহারে এসে একটা মস্ত বড় খবর পেয়ে গেলাম। নারায়ণগঞ্জ থেকে আটটা ফ্ল্যাট প্রায় দেড় লক্ষ মণ পাট বোঝাই হয়ে খুলনার দিকে যাচ্ছে। আমাদের শত্রুরা আমাদের এই পাট বিদেশে রফদানি করে মুনাফা লুটবে, আর হয়তো বা সেই টাকা দিয়ে আমাদের মারবার জন্য অস্ত্র আমদানী করবে। ফ্ল্যাটগুলি এই মধুমতি নদীর তীর ঘেঁষেই চলে যাবে।

 এই খবর পেয়ে আমরা একদল মুক্তিযোদ্ধা এই ফ্ল্যাটগুলিকে অভ্যর্থনা করবার জন্য মাণিকদা গ্রামে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। অবশেষে যথাসময়ে ফ্ল্যাটগুলি মানিকদার কাছে তালাঘাটে এসে ভিড়ল। আমরা আগে থেকেই ফ্ল্যাটগুলির উপর হামলা করবার জন্য তেরী হয়ে ছিলাম। ওরা পালিয়ে যাবার জন্য চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারল না। আমরা ওদের সব পাট পুড়িয়ে ছাই করে দিলাম।

 ১০ই মে তারিখ নারায়ণগঞ্জ থেকে রকেট স্টীমারটি সৈন্যদের রসদে বোঝাই হয়ে খুলনার দিকে যাচ্ছিল। তাছাড়া এই স্টীমারে একজন মেজর নেতৃত্বে ৫০জনের মত সৈন্যও যাচ্ছিল। এই সৈন্যদের সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র ছিল না এবং তারা সাদা পোশাকেই চলেছিল। রকেট স্টীমারটি ভালাঘাটে এসে ভিড়ল। আমরা তখনও মাণিকদাতেই ছিলাম। এই খবরটা আমাদের কাছে এসে গিয়েছিল। স্টীমারটা ঘাটে ভিড়বার সাথে সাথেই আমাদের মুক্তিবাহিনী তাকে ঘেরাও করে ফেলল। ওদের আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। আরোহীদের নদীর তীরে নামিয়ে দিয়ে আমরা স্টীমারটিকে ডুবিয়ে দিলাম। তারপর মেজরসহ সৈন্যদের খতম করে দেওয়া হলো।

 সেই দিনই রাত্রিতে খুলনা থেকে একটা রসদ-বোঝাই লঞ্চ এবং বরিশাল থেকে একটা সৈন্যবাহী লঞ্চ গোপালগঞ্জের দিকে যাচ্ছিল। আমরা খাদ্যবাহী লঞ্চটিকে ডুবিয়ে দিলাম। আমাদের প্রবল গুলিবর্ষণের ফলে রাত্রির অন্ধকারে সৈন্যবাহী লঞ্চটিও ডুবে যায়। এই অঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর উৎপাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো। গোপালগঞ্জের এসডিও হত্যা, দেড় লক্ষমন পাট পুড়িয়ে দেওয়া, সৈন্যবাহী লঞ্চ ডোবান-পর পর এই সমস্ত ঘটনা মুক্তিবাহিনীর প্রভাব বাড়িয়ে চলেছিল; অপরপক্ষে সামরিক কর্তৃপক্ষের মর্যাদার হানি ঘটছিল। তাই আমাদের নির্মূল করে দেবার জন্য তারা উঠে পড়ে লাগল।