পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৭৮

 সেই দিনটা ছিল ১১ই মে। এই তারিখটা আমার পক্ষে ভূলে যাওয়া সম্ভব নয়। ওদের গুপ্তচরের মুখে ওরা আমাদের অবস্থানটা জানতে পেরেছিল। সেদিন আমাদের জায়গা থেকে বেশ অনেকটা দূরে ওরা লঞ্চ বোঝাই সৈন্য নামাল। ব্যাপারটা আমরা একেবারেই টের পাইনি। যখন টের পেলাম, তখন আমরা প্রায় ঘেরাও হয়ে এসেছি। সেই ঘেরাও থেকে বেরিয়ে আসা সহজ কথা নয়। আমার কথা বলি, আমি ওদের একদল সৈন্যর একবারে কাছাকাছি গিয়ে পড়েছিলাম। আমার ভাগ্য ভাল, ওরা আমাকে ওদের একজন বলে ভুল করে বসেছিল। তাই আমার কাছ থেকে ওরা আক্রমণ আশঙ্কা করেনি। আর আমিও ওদের অপ্রস্তুত অবস্থায় মেশিনগান দিয়ে এক পশলা গুলিবর্ষনের সুযোগ পেয়ে গেলাম। ফলে ওদের মধ্যে অনেক সৈন্য হতাহত হলো। সেদিন আমরা গুলি চালাতে চালাতে বহু কষ্টে ওদের সেই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমি নিজে একবারে অক্ষত অবস্থায় চলে আসতে পারিনি। এতদিন এত সমস্ত সংঘর্ষের মধ্যেও আমার গায়ে এতটুকু আঁচড় লাগেনি। কতবার কত গুলি আমার কানের পাশ ঘেঁষে চলে গেছে, কতবার কত গুলিবৃষ্টির মধ্য দিয়ে অক্ষত দেহে বেরিয়ে এসেছি। ফলে আমার মনে মনে কেমন একটা বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল যে, ওদের গুলি আমাকে স্পর্শ করতে পারে না। কিন্তু আজ শত্রুরা আমার দেহে ওদের দাঁত বসিয়ে দিয়েছি। বইরে বেরিয়ে এসে দেখি আমার এই হাত থেকে অবিরাম ধারার রক্ত ঝরে চলেছে। আমার হাতে একই সঙ্গে তিনটি গুলি এসে বিদ্ধ হয়েছে।

 বলতে বলতে মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রউফ তাঁর ব্যাণ্ডেজ বাঁধা বাঁ হাতখানি আমার সামনে তুলে ধরলেন।

 কি করেলেন তারপর? জখম হাতটার কি ব্যবস্থা করলেন? প্রশ্ন করলাম আমি।

 আমি যে জখম হয়েছি, ওরা এই খবরটা জানতে পেরেছিল এবং আমি কে সেটাও ওদের অজানা ছিল না। ইতিমধ্যে এখানকার মুক্তিযুদ্ধের নেতা হিসাবে আমার নামটা এখানকার সর্বত্র প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল। ওরা মনে করেছিল, আমি নিশ্চয়ই আমার এই জখমটার চিকিৎসার জন্য কাছাকাছি কোন ডাক্টারখানায় বা কোনও ডাক্টারের কাছে যাব। তাই ওরা আমাকে ধরবার জন্য সেই সব জায়গায় হামলা করেছে। কাজেই আমার পক্ষে সেইসব জায়গায় যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আট-দশ দিন বিনা চিকিৎসাতেই কাটল। ফলে সেপটিক হয়ে আমার হাতটা পেকে উঠল। ঐ অবস্থায় আর কিছুদিন থাকলে নির্ঘাত মারা যেতাম। তখন বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলেন জখম চিকিৎসার জন্য বর্ডারের ওপারে চলে যেতে হবে। আমার অবস্থা যে রকম দাঁড়িয়েছিল, তাতে এ ছাড়া আমার বাঁচার আর কোন উপায় ছিল না।