অনুমতি দিতে পারি না। আমি অফিসেই বেলা প্রায় দু’টা পর্যন্ত বসে রইলাম। এসময় ইউনিটের বেশ কয়েকজন বাঙ্গালী সৈন্য আমার নিকট এসে শহরে ভয়াবহ পরিস্থিতির খবর জানায় এবং এমতাবস্থায় তাদের কি কর্তব্য তা আমার নিকট থেকে জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। আমি তাদেরকে কিছুটা সান্ত্বনা দেই ও আরও কিছু সময়ের জন্য ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করতে বলি। তারপর আড়াইটার সময় আমি আমার মেসে খেতে যাই এবং খাবার পর কক্ষে প্রবেশ করলে আমার সিপাই মোশাররফ (যার নিকট একটা স্টেনগান থাকত) আমাকে জানায় যে তার নিকট থেকে পাঞ্জাবীরা স্টেনগানটি নিয়ে নিয়েছে। সিপাই মোশাররফের কাছ থেকে স্টেনগান কেড়ে নেয়ায় আমার একটু ভয় হয় এবং অত্যন্ত চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ি। তার পরই আমাদের পাশের বাড়িতে মেজর মওলার (বাংগালী-১৪৯ ইনফ্যানট্রি ওয়ার্কশপের কমাণ্ডিং অফিসার) নিকট গিয়ে স্টেনগান কেড়ে নেয়ার কথা জানাই এবং আমরা যারা বাঙ্গালী ছিলাম সবাই নিরাপত্তার কথাও বলি। আমার কথা শুনে মেজর মওলা বলেন, বাঙ্গালীদেরকে পাঞ্জাবীরা মারবে না- মারতে পারে না। কিন্তু তবু আমরা তিনচারজন অফিসার রাতে তার বাসায় থাকা ও ঘুমানোর কথা বলি এবং আরও জানাই যে আমাদের ঘুমের সময় একজন অফিসার রাতে সব সময় পাহারা থাকবে। তিনি রাজী হলেন। আমি, ক্যাপ্টেন এনাম এবং মুস্তাফিজ ও মেজর ইকবাল তার বাসায়ই থাকি। কিন্তু সারারাত গুলির আওয়াজ এবং মীরপুর, গুলশান এলাকায় আগুন লাগানো দেখে আমাদের মোটেই ঘুম হয়নি।
২৭শে মার্চ, সকাল সাড়ে সাতটায় আমি অফিসে গেলে দেখতে পাই যে, তিনটা ই-পি-আর ট্রাক অসংখ্য রাইফেল ও অস্ত্রশস্ত্র (অস্ত্রগুলোতে অনেক লাল রক্ত লাগানো দেখতে পাই) নিয়ে ক্যাণ্টনমেণ্ট এলাকায় ঢুকছে। আমার অফিসের অনেক বাঙ্গালী সিপাই আমাকে জানায় যে, ই-পি-আর ক্যাম্প এবং রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্পে পাঞ্জাবীরা নিষ্ঠুরভাবে আক্রমণ করে এবং বহু ই-পি-আর ও পুলিশকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এ সময় আমি আমার শহরের আত্মীয়স্বজনের কোন খবরা খবর না পেয়ে খুবই চিন্তায় পড়ি এবং আমি মেজর মনোয়ার হোসেনকে কঠোরভাবে জানাই যে, যে কোন প্রকারে হোক আমাকে অন্তত আধ ঘণ্টার জন্য শহরে যেতে হবে। পরে মেজর মনোয়ার হোসেন আমাকে শহরে যাবার অনুমতি দেন। অনুমতি পাওয়ার পর আমি সকাল দশটার সময় মেজর এম, এম, দৌল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারকে (জি-২ ইনটেলিজেন্স হেড কোয়ার্টার, ইস্টার্ন কমাণ্ড) সঙ্গে নিয়ে জীপে শহরে চলে যাই।
সেদিন সকাল দশটা থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত কোনো কারফিউ ছিল না। আমরা যাবার পথেই দেখলাম অসংখ্য নারী শহর ছেড়ে বাইরে চলে যাচ্ছে। এয়ারপোর্ট এলাকা পার হবার পর আমরা স্বচক্ষে যা দেখলাম তা হলো?
ফার্মগেটের পরে আওলাদ হোসেন মার্কেটের সমস্ত কাঁচা ঘরবাড়ি এবং দোকানপাট (কমপক্ষে ৬০/৭০ টি) জ্বালিয়ে দিয়েছে।
ইস্কাটন রোডে আমার ভগ্নিপতি জনাব এস, আর, খান (সেকশন আফিসার, মিনিস্ট্রি অব ইনফরমেশন)-বাসায় যাই। সেখানে তাদের মুখে শুনতে পাই যে ঐ এলাকায় পাঞ্জাবীরা ২৫শে ও ২৬শে মার্চ রাস্তায় বাঙালী যাদেরকেই পেয়েছে তাদের সবাইকে জঘন্যভাবে হত্যা করে রাস্তার আশেপাশে মাটিতে চাপা দিয়েছে। ইস্কাটন রোড থেকে বের হয়ে যখন আমরা হোটেল ইণ্টারকণ্টিনেণ্টালের কাছে পৌঁছলাম তখন ডানদিকে দি পিপল পত্রিকার অফিসে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে এবং অসংখ্য মৃত লাশ পড়ে রয়েছে এবং অনেক লাশ আগুনে জ্বলছো ঐ রাস্তা দিয়ে রাতে ট্যাংক চালানো হয়েছে। ট্যাংকের চেইন-এর ছক তখনো রাস্তায় ছিল।
সেখান থেকে আমরা হাতিরপুলে মেজর দৌল্লাহ সাহেবের বাসায় যাই। সেখানে মেজর দৌল্লাহ সাদেশের ছোট ভাই জনাব আসফউদ্দৌলাহ (বর্তমান জয়েণ্ট সেক্রেটারী, ওয়ার্কস) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকবাল হল, যুগন্নাথ হল ও ঠাফ কোয়াটারে ঢুকে পাঞ্জাবীরা কিভাবে জঘন্যভাবে ছাত্র ও শিক্ষকদের হত্যা করেছে তার