পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৯৩

অল্প সময়ের মধ্যে সমস্ত মৃতদেহ অন্যত্র সরাইয়া দাফন করিয়া ফেলা হয়। আর এদিকে দ্রুতগতিতে লাইনের ভিতরকার সবকিছু যথাসম্ভব গোছগাছ করিয়া নিয়া হেডকোয়ার্টারের চতুর্দিকে দৃঢ় প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করা হইল। সুবেদার হাফিজের নেতৃত্বে তাঁহার নিজস্ব ডি কোম্পানী ব্যতীত আরও কিছু আসার-মুজাহিদ এই প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে মোতায়েন রহিল।

 ওদিকে স্থানীয় এম-সি-এ জনাব ফজলুল করিমের নেতৃত্বে ঠাকুরগাঁ শহরে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হইল। আমাদের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ স্বেচ্ছায়ই তাহারা গ্রহণ করিলেন। তাহাদের কর্তব্য ঠিছল শহরের শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং প্রয়োজনমত যুদ্ধরত লোদের নানা কাজে সাহায্য করা। ছাত্র- জনতা আমাদের পার্শ্বে থাকিয়া যে সাহায্য করিয়াছে তাহা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। স্থানীয় নারী সমাজ পর্যন্ত এই সংগ্রামে প্রচুর সাহায্য ও সমর্থন দিয়াছে। ঐ দিন (৩০শে মার্চ) সন্ধ্যা পর্যন্ত সীমান্তস্থ কোম্পানীসমূহের লোকজন ঠাকুরগাঁয় আসিয়া সমবেত হয়। আমাদের জোয়ানরা ও স্থানীয় জনসাধারণ আমাকে মেজর পদে বরিত করিয়া যুদ্ধের পূর্ণ দায়িত্ব আমার উপর অর্পণ করিলেন। বৃদ্ধ বয়সে ঘোর দুর্যোগের সময় এত বড় দায়িত্ব আমাকে বহন করিতে হইল। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার নাম স্মরণ করিয়া জনসাধারণের শুভাশীষ নিয়া আমি আমার ব্যাটালিয়নকে পুনর্গঠন করিয়া আগামী দিনের জন্য সকলকে তৈয়ার করিতে লাগিলাম এবং সামান্য ভাষণের মাধ্যমে আমরা সমবেতভাবে শপথ নিলাম।

 এই দিন বিকালেই সুবেদার আবদুল খালেকের নেতৃত্বে আমাদের দুই কোম্পানী এবং এক কোম্পানী মুজাহিদকে সাধ্যানুযায়ী সুসজ্জিত করিয়া ঠাকুরগাঁর ২৩ মাইল আগে ভাতগাঁও পুল প্রতিরক্ষার্থে পাঠানো হয়। নায়েক সুবেদার বদিউজ্জামানের অধীনে আমাদের সি কোম্পানীকে এক কোম্পানী মুজাহিদসহ দেবীগঞ্জে পাঠানো হইল। হাবিলদার নুর মোহাম্মদের অধীনে এক প্লাটুন ইপিআর এবং এক প্লাটুন মুজাহিদ শিবঞ্জ বিমান বন্দর প্রতিরক্ষার জন্য পাঠানো গেল। বাকী সদর কার্যালয়ের সঙ্গে এক কোম্পানী অতিরিক্ত হিসাবে রাখা হইল। সে রাতেই আনসার-মুজাহিদ ভাইয়েরাও অধিক মাত্রায় আসিয়া একত্রিত হইতে লাগিল। সহকারী আনসার এ্যাডজুটেণ্ট (মহকুমা) জনাব কবির তাহাদিগকে পুনর্গঠন করিয়া আমার পার্শ্বে থাকিয়া অনেক সাহায্য করিতে লাগিলেন। আমরা সীমান্ত এলাকাকে দুইটি সাব সেক্টরে ভাগ করিয়া সুবেদার আবুল হাশেম ও নায়েক সুবেদার হাজী মুরাদ আলীকে যথাক্রমে পঞ্চগড় সাবসেক্টর ও রুহিয়া সাবসেক্টরের দায়িত্বভার অর্পণ করি এবং নিম্নোক্ত বিষয়গুলি তাহাদের দায়িত্বের অন্তর্গত করিয়া দিইঃ (১) সীমান্ত রক্ষণাবেক্ষণ করা আঞ্চলিক আনসার-মুজাহিদদের সহযোগিতায়; (২) এলাকায় জনসাধারণের এবং সরকারী বেসরকারী সম্পত্তির নিরাপত্তা বিদান করা; (৩) আনসার মুজাহিদদের পুনর্গঠন, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এবং ছাত্রদের সামরিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা; (৪) বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং প্রয়োজনীয় বিষয়াদি সদর কার্যালয়ে অবহিত করা; (৫) বন্ধুরাষ্ট্রের যে কোন সাহায্যের জিনিসপত্র সমিতির মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে বণ্টনের তদারক করা; (৬) রণাঙ্গনের খবর কতিপয় নির্দিষ্ট লোককে জ্ঞাত করানো। এমনিভাবে সবরকম আদেশ উপদেশ দিয়া তাহাদেরকে নিজ নিজ জিম্মাদারী এলাকায় মোতায়েন করা হইল।

 ইতিমধ্যে হেডকোয়ার্টার এবং বর্ডারের বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত বিপ্লব অপারেশনের বিস্তারিত খবর আমাদের নিকট আসিয়া পৌঁছিল। হিসাবে দেখা গেল, এই অপারেশনে বর্ডারে আমাদের একজন মাত্র লোক আহত হইয়াছে। সে হাবিলদার আব্দুল আজিজ। হেডকোয়ার্টারে চারজন ঘোরতর জখম ও দুই জন শহীদ। জখমী (১) হাবিলদার দীন মোহাম্মদ (২) সিপাহী ওলিউল্লাহ ভূঞা (৩ সিপাহী আবু তাহের (৪) একজন মুজাহিদ কমাণ্ডার এবং শহীদ (৫) সুবেদার আতাউল হক (৬) ল্যান্স নায়েক জয়নাল আবেদীন। এই সামান্য ক্ষতির বিনিময়ে আমরা এক মেজর ও এক ক্যাপ্টেনসহ প্রায় ১১৫ জন খান সেনাকে খতম করি-যাহাদের অধিকাংশই ছিল কমিশনড, জুনিয়র কমিশনড ও নন কমিশনড অফিসার এবং বয়সে প্রবীণ, অভিজ্ঞতায় পরিপক্ব ও সামরিক প্রশিক্ষণে নিপুণ আর সর্বোপরি এই এলাকার রাস্তাঘাট ও অবস্থান এবং আমাদের বৈশিষ্ট্য সমন্ধে ছিল বিশেষ