পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৯৪

ওয়াকিফহাল। তাই সার্বিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইহা আমাদের পক্ষে ছিল এক বিরাট সাফাল্য। পশ্চিমা হতাহতদের মধ্যে ছিল ইপিআর-এর ১০৪, আর্মির ৮ এবং বিমান বাহিনীর ৩ জন।

 ৩০শে মার্চ হইতেই সকল গ্রামেগঞ্জে, স্কুল কলেজে যুবকদের সামরিক শিক্ষা চলিতে লাগিল। আমার ব্যাটালিয়ন ছাড়া একদিনের মধ্যেই এক ব্যাটিলিয়ন আনসার ও এক ব্যাটালিয়ন মুজাহিদ পুনর্গঠিত হইল। এক ব্রিগেডের মত শক্তি নিয়া (অবশ্যই শুধু সংখ্যানুপাতিক) আমরা বিখ্যাত সৈয়দপুর শত্রু ছাউনি আক্রমণ করিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করিলাম। এই দিকে দিনাজপুর হইতেও সাহায্য পাইবার আশ্বাস পাইলাম। পরিকল্পনা অনুসারে ইপিআর, আনসার ও মুজাহিদদের মিলিত বাহিনীকে প্রয়োজনভিত্তিক প্লাটুন ও কোম্পানী পর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হইল বিশেষ করিয়া সৈয়দপুর- ঠাকুরগাঁর মধ্যে যোগাযোগকারী বিভিন্ন রাস্তার উপর অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে। এইভাবে ক্রমে ক্রমে ডাইনে বীরগঞ্জ, শালবাগান, ভাতগাঁ এবং বাঁয়ে খানসামা, দেবীগঞ্জ, জয়গঞ্জ, ঝারবাড়ী প্রভৃতি স্থানে অনেকগুলি রক্ষাব্যূহ তৈয়ার করিয়া আরও অগ্রসর হইবার প্রয়াস পাইলাম। অবশ্য স্থানগুলি ছিল একে অন্য হইতে বহু দূরে এবং যোগাযোগের দিক দিয়া একেবারেই বিচ্ছিন্ন। না ছিল কোন পজিশন অন্য পজিশনের বদলী বা অবস্থান- প্রস্থানের কিছুই জানিত না। অথচ আধূনিক সমরে এ রীতি সম্পূর্ণ অচল। খাদ্য এবং অন্যান্য সামরিক সরবরাহের ব্যাপারও ছিল সম্পূর্ণভাবে জনসাধারণের উপর নির্ভরশীল। কাজেই অনাহার- অর্ধাহার ছিল নিত্যসঙ্গী।

 ইতিমধ্যে সৈয়দপুরে ৩নং বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করিলাম, তবে মাত্র তাহাদের সি কোম্পানীর লোকজন সেখানে ছিল। তাঁহারাও ততক্ষণে খানদের দ্বারা একবার আক্রান্ত হইয়া বিধ্বস্ত অবস্থায় সেখান হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছে। তাহাদের কোম্পানীর লোকজন পুরা ছিল না এবং তাহার নেতৃত্ব দিতেছিলেন ক্যাপ্টেন আশরাফ। যাহাই হউক, তাহাদের সহযোগিতায় সৈয়দপুরের দিকে অগ্রাভিযানের প্রস্তুতি চলিতে লাগিল। পিছনের দিকে পূর্বে কথিক হাবিলদার নূর মোহম্মদের নেতৃত্বাধীন প্লাটুনদ্বয় ঠাকুরগাঁ বিমানবন্দরের হেফাজত করিতে লাগিল এবং তথাকার ম্যানেজার আতাউর রহমান ও স্থানীয় জনগণের সহায়তায় বিমানবন্দরকে নানা উপায়ে শত্রুর ব্যবহারের অনুপযুক্ত করিয়া ফেলা হইল।

 ৩১শে মার্চ। বন্ধুরাষ্ট্রের ৭৫ নং বিএসএফ ব্যাটালিয়নের কমাণ্ডার কর্নেল ব্যানার্জী সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করিলাম। তিনি সব রকম সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি দিলেন। পহেলা এপ্রিল রাত্রে কর্নেল ব্যানার্জী সাহেবকে আমাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলি পরিদর্শন করাইলাম, তিনি আমাদের কাজের বিশেষ প্রশংসা করতঃ তাঁহার নিজের কিছু পরিকল্পনা ব্যক্ত করিলেন। আমরা তাঁহার উপদেশ মত নিজ বাহিনীকে সৈয়দপুরের আরও কাছাকাছি নিয়া যাইবার পরিকল্পনা নিলাম। ২রা এপ্রিল হঠাৎ আমরা পুরানো কমাণ্ডিং অডফিসার পাক আর্মির অবসরপ্রাপ্ত মেজর এম, টি হুসেন আমার সহিত দেখা করিয়া আলাপচারী হইলেন। তাঁহার প্রাথমিক আলাপের অবিকল উদ্ধৃতি নিন্মে দেওয়া হইলঃ “সুবেদার মেজর সাহেব, আপনি আপনার লোকজনসহ দেশের মুক্তি আন্দোলনে ঝাঁপ দিয়াছেন তাহা সত্যি অদ্ভুত। আপনি আমাকে আপনার সঙ্গে কাজ করিবার সুযোগ দিবেন কি।” আমি আনন্দের সঙ্গে তাহাকে গ্রহণ করিলাম ও আমাদের কমাণ্ডিং হিসাবে নিযুক্ত করিলাম।

 এক্ষণে আমরা আরও নতুন উদ্যম নিয়া কাজ করিতে লাগিলাম। পরদিন ৩রা এপ্রিল আমরা দিনাজপুর গেলাম এবং সেখানকার সরকারী ও বেসরকারী নেতা ও কর্মচারীবৃন্দকে নিয়া একটি সভা করিয়া আগামী দিনের পরিকল্পনা নিয়া আলোচনা করিলাম। পরিকল্পনা মাফিক ঐদিন ৩রা এপ্রিল ঠাকুরগাঁর রক্ষাবূহ্য উঠাইয়া ফেলা হয় আর সুবেদার হাফিজকে তাহার ডি কোম্পানীসহ সবার আগে দশ মাইল তে- রাস্তার মোড়ের প্রায় দেড় মাইল পূর্বে দিনাজপুর - সৈয়দপুর প্রধান সড়কের উপর করা হইল। সেখানে গিয়া তাঁহারা ক্যাপ্টেন আশরাফের ৩ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সি কোম্পানী সহিত মিলিত হন। তাহারা মিলিভাবে সৈয়দপুরগামী সড়কে